।। মীর সালমান শামিল ।।
আমেরিকার মানুষ ইংরেজি ভাষায় কথা বলে কিন্তু তারা ইংরেজ না।
ব্রাজিলের মানুষ পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলে কিন্তু তারা পর্তুগিজ না।
অস্ট্রিয়ার মানুষ জার্মান ভাষায় কথা বলে কিন্তু তারা জার্মান না।
ইথিওপিয়ার মানুষ সোমালি ভাষায় কথা বলে কিন্তু তারা সোমালি না।
মেক্সিকোর মানুষ স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে কিন্তু তারা স্প্যানিশ না।
এমন আরো ডজন খানিক জাতি এবং দেশের উদাহরণ দেওয়া যাবে। উপরোক্ত উপাত্ত দিয়ে আমি একটা ব্যাপার বলার চেষ্টা করছি তা হল ভাষা এবং কালচার অভিন্ন সত্ত্বা নয়। ভাষা কালচারের একটা অনুষঙ্গ বটে তবে একমাত্র অনুষঙ্গ না, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গও না। আমেরিকার মানুষ যদিও ইংল্যান্ড থেকেই আমেরিকা গিয়েছিল, ইংরেজি ভাষায় কথা বলে, কিন্তু তারা ইংরেজ না, ইংরেজ কালচারের অংশও না।
যদি বাংলা ভাষায় কথা বললেই আপনি তাকে বাঙালি বলেন তাহলে বাঙলাদেশের মুসলমানদের বাঙালি বলতেই পারেন। কিন্তু বাঙালি দিয়ে যদি একটা কালচারকে বোঝান হয় তাহলে আলাপ ভিন্ন। এই বাঙালিয়ানার সূচনা হল কিভাবে?
এজন্য আমাদের এই এলাকার সামাজিক ইতিহাস বিবেচনায় রাখা জরুরী। আমরা এখন হিন্দু ধর্মকে যেমন সংগঠিত ধর্ম হিসেবে দেখি ৩০০/৪০০ বছর আগে ব্যাপারটা এমন ছিল না, এই নামটাও ছিল না। এই উপমহাদেশে বিভিন্ন প্রকৃতি এবং প্রতিমা পূজারী সম্প্রদায় ছিল। তারা নিজেদের এক ধর্মের মানুষ হিসেবেও বিবেচনা করতো না। আল বিরুনী তার মাস্টারপিস ভারততত্ত্ব বইয়ে এই ব্যাপারটা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেছেন।
বৃটিশরা পাক-ভারতে প্রথম আদমশুমারি করার সময় ধর্মের হিসাব করতে সিংহভাগ মূর্তি পূজারীদের “হিন্দু ধর্ম” নামক টার্মের নিচে রাখে। কিন্ত তখনো উপমহাদেশের মূর্তি পূজারীরা কখনো নিজেদেরকে হিন্দু বলতো না। হিন্দু সমাজের বড় বড় পন্ডিতেরা যেমন স্বামী বিবেকানন্দ, দয়ানন্দ স্বরসতী প্রমুখ এই ‘হিন্দু’ শব্দ ব্যবহারের বিরোধিতা করেন৷ এখনো বড় বড় হিন্দুগুরুরা ‘হিন্দু’ শব্দ ব্যবহার করে না।
কারণ এই হিন্দু শব্দটা সংস্কৃত শব্দ না, এটা মুসলমানি ফারসি শব্দ। ইরান-আরব মুসলমানেরা হিন্দুকুশ পর্বতের আশেপাশে বসবাসকারীদের হিন্দু বলতো; মুসলমান, পৌত্তলিক, বৌদ্ধ সবাইকেই হিন্দু বলতো। পরে আস্তে আস্তে কিছু পৌত্তলিকদের হিন্দু বলা শুরু হয়। বৃটিশরা সেই টার্ম গ্রহণ করে।
প্রথমে কিছু মূর্তি পূজারী সম্প্রদায়কে হিন্দু হিসেবে অধিভুক্ত করে। পরে আস্তে আস্তে অন্য সম্প্রদায়কেও হিন্দু বলে অধিভুক্ত করা হয়। এই প্রক্রিয়া এখনো চলমান। যেমন সিলেটের প্রকৃতি পূজারী পাত্র সম্প্রদায়কে মাত্র বছর বিশেক আগে হিন্দু বলে অধিভুক্ত করা হয়। এভাবে ব্রিটিশরা হিন্দুধর্মকে সংগঠিত করে।
আরও পড়ুন-
উনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজি শিখে, ইংরেজদের সহায়তা করে কলকাতার হিন্দুরা অর্থনৈতিকভাবে বেশ শক্তিশালী হয়ে যায়। তার প্রভাব পরে সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, উৎসব, গান, স্থাপত্য, জীবন আচারসহ অন্য সকল ক্ষেত্রে। হিন্দুদের মাঝে কলকাতাকে কেন্দ্র করে একটা রেনেসাঁস হয়। এই রেনেসাঁসের প্রধান অর্জনগুলো হল—
১। সতীদাহ প্রথা বিলাপ।
২। বিধবা বিবাহের প্রচলন।
৩। ব্রাহ্মণদের একাধিক বিয়ে— কৌলিন্য প্রথার বিলোপ।
৪। ব্রাহ্ম ধর্মের সূচনা।
৫। বাংলা গদ্যের সূচনা।
৬। বাংলা মঞ্চ নাটক, নাট্যদলের সূচনা।
৭। দূর্গা পূজার ব্যাপক বিস্তার।
এ রেনেসাঁসের পুরোধা হলেন রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখ। এই রেনেসাঁসকে কেন্দ্র করে একটা সাংস্কৃতিক ধারা গড়ে উঠে। এই রেনেসাঁস পুরোপুরি হিন্দুধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট। মুসলমান সমাজে সতীদাহ, বিধবা বিবাহ বা কৌলিন্যের ব্যাপার কখনো ছিল না।
কিন্তু রেনেসাঁসের কেষ্টুবিষ্টুরা একে হিন্দু রেনেসাঁস এবং হিন্দু সংস্কৃতি না বলে অভিহিত করেছিলো বাংলা রেনেসাঁস এবং বাঙালি সংস্কৃতি বলেছিলো। এবং সেখান থেকেই হালের এই “বাঙালিয়ানা”র শুরু।
তাদের কাজের যুক্তি আছে, কারণ হিন্দু সংস্কৃতি বললে সেটা অর্থবহ হয় না, গান্ধার থেকে আরাকান পর্যন্ত হিন্দুরা ছড়িয়ে আছে। বঙ্গের হিন্দুদের সাথে তামিলনাড়ু, গুজরাট বা ইউপির হিন্দুদের সাংস্কৃতিক ভেদ বিস্তর। উপরুন্তু এই রেনেসাঁসের রথি-মহারথিরা একটা নতুন ধর্মের প্রচলন করেছিলো। নাম ব্রাহ্ম ধর্ম। তারা নিজেকে বলতো ব্রাহ্ম। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রবীন্দ্রনাথ বা সত্যজিৎ রায়েরাও সবাই নিজেদের বলতো ব্রাহ্ম।
ব্রাহ্ম ধর্মের সূচনা নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার প্রথম আলো উপন্যাসে স্বামী বিবেকানন্দের মুখ দিয়ে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছে। অনেকটা এই রকম,
❝ উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি হিন্দুরা শিক্ষা-দীক্ষায় ব্রিটিশদের সমকক্ষ হয়ে যায়। তাদের মাঝে বন্ধুত্ব, সামাজিক সম্পর্ক তৈরি হয়। শুধু একটা জায়গাতে তারা লজ্জায় পড়ে যেতো তা হল ৩২ কোটি দেবতা। এটা নিয়ে ব্রিটিশরা হাসা-হাসি করতো। এই লজ্জা থেকে বাঁচতে তারা একেশ্বরের উপাসনা করার তত্ত্ব নিয়ে আসে। ❞
তবে বাস্তবে ব্রাহ্ম ধর্ম ছিল আসলে এটা একটা নাম পদ মাত্র। এই ব্রাহ্ম ধর্মের কোন মেটা ফিজিক্স নেই, জীবনবোধ নেই, নেই উৎসব। এই ধর্মের হোতারা সবাই ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনাচারে কঠোর ভাবে হিন্দু ধর্মের রীতি মেনে চলতো। যেমন ব্রাহ্ম সমাজের ঠাকুর বা মহির্ষি ছিল দেবেন ঠাকুর। কিন্তু ঠাকুর পরিবারে জাত-পাত উগ্রভাবে মানা হতো। প্রতিটি পূজা পালন করা হতো। ছেলে-মেয়েদের বিয়েও হয়েছে ব্রাহ্মণদের সাথেই।
ব্রাহ্মরা পূজা-পার্বণ পালন করতো এটা আমাদের বাঙালিদের “কালচার” বলে। এভাবেই হিন্দু ধর্ম এবং বাঙালিয়ানা অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়৷ কালচার একটা বিশাল কনসেপ্ট, ভাষা তার অনুষঙ্গ মাত্র। রবীন্দ্রনাথ যখন নওয়াব আলী চৌধুরীকে বলেছিল,
❝ মুসলমান বিদ্বেষী বলিয়া আমারা আমাদের জাতীয় সাহিত্য(বঙ্কিমের লেখা) পরিত্যাগ করিতে পারিনে। মুসলমানদের উচিত তাদের নিজেদেরই নিজেদের জাতীয় সাহিত্য তৈরি করা। ❞
কিংবা শরৎ লেখে ❝ মুসলমান আর বাঙালির ফুটবল খেলা হচ্ছে। ❞
আরও পড়ুন-
রবীন্দ্রনাথ কিংবা শরৎ ভালভাবেই জানেন এই মুসলমানও বাংলা ভাষাতেই কথা বলে, কিন্তু সেটা তাদের কাছে বাঙালি হবার জন্য যথেষ্ট না। এবং তাই গত ১১শ বছর ধরে এই দেশের মুসলমানরা জুব্বা-টুপি কিংবা বোরকা পরার পরেও এগুলো কলকাতার স্টাবলিশমেন্টের কাছে “বাঙালির পোশাক না”।
জীবনবোধ, উৎসব, পোশাক, খাবার, খাবারের পাত্র, স্থাপত্য, জাতীয় বীর, নাম, বাচ্চাদের শোনানো গল্প, সাহিত্য; এগুলো কালচারের মূল অনুষঙ্গ। পূর্ব বাংলার মানুষের এগুলোর সাথে কি কলকাতার বাঙালিয়ানার কোন মিল খুঁজে পান?
এমনকি ১৯৯৪ সালে চালু করে হাজার বছরের বলা গার্বেজটাও একই দিনে হয় না। ঢাকায় পহেলা বৈশাখ এবং মঙ্গলযাত্রা করার পরের দিন কলকাতা পহেলা বৈশাখ করে। দুই বাঙলার পঞ্জিকা এক নয়। ভাষা একই বাংলা হলেও কলকাতা এবং ঢাকার মানুষদের ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দসমূহ তথা আত্মীয়বাচক শব্দ ভিন্ন।
আমিও মোটেও বলছি না This difference should be weaponized, নাস্তিকদের দীক্ষাগুরু অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সাহেব বলেছিলেন ১২০৩ সাল থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত এই ৫০০ বছরের মুসলমান শাসনামলে অনেক যুদ্ধ হয়েছে মগার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা একটিও হয়নি। আগে যেভাবে সম্ভব হয়েছিল এখনো সেভাবে সম্ভব। শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের জন্য মিথ্যা বায়ান প্রচার করে কোন রকম ভান ধরার দরকার নেই। মিথ্যা দিয়ে মহৎ কিছু করা সম্ভব না।
আমি এক সময়ে মনে করতাম “বাংলা” শব্দটার জন্ম হয়েছে ঢাকার আশেপাশে, বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে মুসলমান শতকরা প্রায় ৬৫ ভাগ। সুতরাং আমরা যা করবো সেটাই আসল বাঙালিয়ানা।
কিন্তু ক্রমেই অনুধাবন হল এই সংস্কৃতিক ধারা জন্ম দিয়েছে ডজন ডজন কবি, সাহিত্যিক, লেখক, চিত্রকর, পরিচালক। একমাত্র ডেমোগ্রাফি দিয়ে সেটাকে চ্যালেঞ্জ করা যায় না। ডেমোগ্রাফি সবকিছু না।
দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ ভিগান কাবাব, ভিগান টিকায়া নামক একটা জিনিশ খায়, কিন্তু আমাদের কাছে ভিগান কাবাব শব্দটাই একটা ব্লাসফেমি। পুরান ঢাকা বা মোহাম্মদপুরের বাবুর্চিরা যদি জানতে পারে, ভিগান কাবাবের কথা, তারা ঘোড়া দাবড়িয়ে আসবে মারতে….
আমাদের নিজেদের জীবনবোধ, মোরালকোড, এবং উৎসব দিয়ে নিজেদের কালচার কোডিফাই করা উচিত। এরপর তার নাম বাঙালি কালচার দেন আর বাংলাদেশি কালচার দেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ না।
লেখকঃ কলাম লেখক ও গবেষণা সহকারী, ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানি
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে- [email protected] ও [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে । আসুন ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।
ফেসবুকে লেখক মীর সালমান শামিল