Ads

নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন অব্যাহত নজরুল-কলমে

।। ড. রমজান আলি ।।

মেধাবী ছেলেগুলাে সব যােগ দিয়েছে একটা ফ্রণ্টে। কেতাবী শিক্ষাকে কিছুটা উপেক্ষা করে তাঁরা প্রতিষ্ঠান বিরােধী,তারা প্রতিরােধী, তারা পরিবর্তনের কাণ্ডারী হয়ে একটা পতাকা ধরেছে। তাদের বিদ্রোেহী-রােমাণ্টিক মন একটা নুতন পৃথিবীর স্বপ্নে বিভাের হয়ে একটা স্বপ্ন দেখতে শেখায়। শাসক অস্থিরতায় আশঙ্কায়। কালে কালে এমনটাই ঘটেছে। পরিবর্তন-রথের চাকা একটু গড়িয়েছে, আবার থেমে গেছে। স্বপ্ন কিন্তু থেমে যায়নি কোনােদিন।

সাহিত্যপ্রমীরা এটা জানেন যে, সৌন্দর্যবােধ আর অজানার রহস্য মিশে একটা কল্পনাচারী মন গড়ে ওঠে। আঠারো শতকের শেষের দিকে নিও-ক্লাসিক সাহিত্যিকগণ কর্মসর্বস্বতা এবং রুচিবাদ সাহিত্যে এক ঘেঁয়েমিতা শুরু করেন। গ্রে, ব্লেক প্রমুখ কবি প্রথম ক্ষীণ বিদ্রোহ শুরু করেন। তার ফলে ইংরাজি সাহিত্যে রােমান্টিক যুগের সূত্রপাত ঘটে। অনেকে মনে করেন ইংরেজি সাহিত্যে রােমান্টিক যুগের সূত্রপাত ১৭৮৯ খ্রিঃ ফরাসি-বিপ্লব থেকে। আসলে ১৭৯৮ খ্রিঃ Lyrical Ballads প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে রােমান্টিকতার সূচনা হয়। এই লিরিক্যাল ব্যালাডসের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং কোলরিজ।এঁদের মূল বক্তব্য ছিল, সাহিত্যের অনুভূতি জন্ম নেয় হৃদয়ে, মস্তিষ্কে নয় -–সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে হৃদয় দিয়েই, বুদ্ধি দিয়ে নয়।অবশ্য এই সামান্য কয়েকটি শব্দ দিয়ে রােমান্টিকতা বলতে বােঝায় জীবনবিমুখ এবং কল্পনাবিলাসী এক ধরণের রস সাধনা কখনাে তা ধ্রুপদী সংযমের বিরােধী, কখনাে কল্পমায়ায় অধ্যাত্মলীলা। একটা অতিরেক ধারণা থেকেই এ ধারণা জন্মেছে। কিন্তু রােমান্টিকরা জীবন বিমুখ নন। কারণ জীবনকে বলিষ্ঠ, সুন্দর এবং তাকে আরাে সজীবতা দান করার জন্যই রােমান্টিক শিল্পীরা ছটফট করেন। রােমাণ্টিক সত্তার পূর্ণ বিকাশের জন্য এমনটাই ছটফট করেছিলেন নজরুল। কেন যে খামকা আমরা তাকে‘বিদ্রোহী,বিদ্রোহী’ বলে লাফাই ? আসলে নজরুল বিদ্রোহী তখনই, যখন তিনি স্বপ্ন দেখানাের কবি ।

আরও পড়ুন-

ভাষা হবে তোমারই বোলে

দার্শনিক জগতের দুটি বিশিষ্ট মতবাদ রােমান্টিকতা সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে। রুশাের বিদ্রোহমূলক জীবনদৃষ্টি এবংঅন্যদিকে জার্মানির দার্শনিক কান্ট ও হেগেল প্রবর্তিত তুরীয়বাদ। এর সঙ্গে ফরাসি বিপ্লববাদ যুক্ত হওয়ার ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং কোলরিজের বক্তব্য প্রকাশে সুবিধা হয়। রােমান্টিকতা বা রােমান্টিসিজমের সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করা শক্ত। ওয়াটস ডানটনের মতে – ‘রােমান্টিসিজম হল বিস্ময় রসের পুনর্জীবন।’ ওয়ান্টর পেটার এর মতে – ‘তা সুন্দরের সঙ্গে অদ্ভুত ব্যাপারের পরিণয় । দার্শনিক ব্রুনেতিয়-এর মতে – ‘সাহিত্যের আত্মমুক্তিই হল রােমান্টিকতা।’ আবার কোনো কোনো সমালােচক একে প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া বা প্রকৃতির রহস্যকে উপলব্ধি করাকে বুঝিয়েছেন। সমালােচক হারফোর্ড তার ‘দি এজ অব ওয়ার্ডসওয়ার্থ’ গ্রস্থে বলেছেন – ‘An extraordinary development of imaginative sensibility.’ একথায় রােমাণ্টিকতা হলাে সুদুর কল্পনাপ্রসারী মনের বিস্তার ও বিস্ফার। নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখানাে দায়বদ্ধতার ভারী ক্রুশকে কাঁধে নেন সত্যদ্রষ্টা কবিরা।

রােমাণ্টিকতার অন্যতম একটি বিষয় হল প্রকৃতি, দ্বিতীয় আর একটি হল প্রেম। শিল্পী সাহিত্যিকদের কাছে প্রেম এমনএকটি বিষয় যা ‘তিলে তিলে নূতন হােয়’। এই বিষয়টা তাই নিরবধিকাল কবিদের তাড়িত করে এবং করবেও। প্রেম সম্পর্কে বিখ্যাত অস্তিবাদী সমালােচক – দার্শনিক কে. গার্ডের বক্তব্য “Love is an emotional action, a warm affirma-tive participation with the other being for its won sake.” অন্যদিকে এলিয়ট বলেছেনঃ ‘Love is nota emotion … but a cognitive act in which we grasp the very essence of another person.’– এমন জটিল প্রেম অস্তিত্ব নিয়ে কবিরা কবিতা রচনায় নানান নতুন তাৎপর্য যােগ করেছেন। কেউ কেউ সেই স্বপ্নের নতুন তাৎপর্যে রচনা করেন ‘বােধ’।

মানুষের প্রয়ােজনে-মানবতা রক্ষার প্রয়ােজনে নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা আবেগ তাড়িত হয়েছে বারে বারে। তবে তার স্বরূপ নির্ণয়ে নজরুল বলেছেন – “আমি পরম আত্মবিশ্বাসী। আর যা অন্যায় বলে বুঝেছি, অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি,মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছি কাহারাে তােষামােদ করি নাই, প্রশংসার এবং প্রসাদের লােভে কাহারাে পিছনে পৌঁ ধরি নাই, আমি শুধু রাজার অন্যায়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করি নাই, সমাজের, জাতির, দেশের বিরুদ্ধে আমার সত্য তরবারীর তীব্র আক্রমণ সমান বিদ্রোহ ঘােষণা করেছে…”

আরও পড়ুন-

তোরা সব জয়ধ্বনি কর

পরিবর্তনের পথ কঠিন হলেও পরিবর্তনকামীরা রােমাণ্টিক। সেই মনােভাবে জগৎ ও জীবনের সংঘর্যে কবি মানস জগৎ সম্পর্কে এক আনন্দিত মুগ্ধ বিস্ময়বােধ প্রকাশ করে। এর মধ্য দুঃখ বিষাদও থাকে। কবি মন থাকে এক কল্পলােকে কতকগুলাে বিষয়কে অবলম্বন করে মানুষের মনে এই বিস্ময়বােধ জাগে। এগুলির একটি হল প্রকৃতি। নজরুলের ‘চাঁদনী রাতে’ কবিতায় প্রকাশিত। আকাশের নীল গাঙে কোদালে মেঘের মউজ, প্রকৃতির এই সৌন্দর্যে চাদনী রাতে যেন তারারা হাবুড়ুবু খায়। মনে হয় চাদের ভেলায় চড়ে কবির আকাশ-প্রিয়ার দিকে যাত্রা। সপ্তর্ষি তারা- পালঙ্কে আকাশ রাণী ঘুমিয়ে আছে, যেন তার লায়লি সহেলি কূহেলী মশারি টেনে দিয়ে গেছে। মঙ্গলগ্রহ মঙ্গল-দ্বীপ জেলে প্রহর জাগে। কবির কালপুরুষ আকাশ-দ্বারীর সঙ্গে তুলনীয়।

হয়তাে একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক শূন্যতার কথা মনে রেখেই নজরুলে কবিতার অনুষঙ্গে এসেছে ইসলামী আবহ। আরবের প্রেম-কাহিনির অনুষঙ্গে তার আকাশ প্রিয়া। প্রাসঙ্গিকভাবে ফরহাদ-শিরী এবং লায়লী-মজনুর কথা এসেছে। কবিতাটিতে চাঁদনী রাতে কবি-হৃদয়ের বিস্ষার ঘটেছে। ‘বর্ষা বিদায়’ কবিতায় কবি বর্যাকে ‘বাদলের পরী’ বলে সম্বোধন করেছেন। খরার পর সে অনুভূতি এবছর অনেকের ঘটেছে। বর্যার বিদায়ে নদীর ঘাটে কতকী পাতা তরীর রূপ গ্রহণ করে। আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাস অতিবাহিত করে ভাদ্র মাসে তার অভিসার শেষ হয়। তার পরশ না পেলে কেয়া রেণু পাণ্ডুর রূপধারণ করে। তার কথা স্মরণ করে নদীতটে কাঁদে বেণু। ভীরু কুমারীর বেদনা বিধুর প্রণয় অশ্রর মতাে শিশির সিক্ত শেফালী তারই ছোঁয়ায় ঝড়ে পড়।

‘কাজল-মেয়ে’ সম্বাধন করে কবি বর্ষার স্পর্শ প্রকৃতি জগতের নানা রূপাস্তরের কথা বলেছেন। বর্ষা শেষে কাশফুলের মতাে শুভ্র মেঘেরা আকাশের কোলে খেলে বেড়ায়, বৌ-কথা কও পাখি ডেকে উঠে। তার বিদায়ে নদীর কুল ছাপিয়ে ছলছল সুরে কেঁদে উঠে। এবার বর্ষা মেঘ হয়ে দুর হিম গিরিতে যাত্রা করবে, যেখানে বাংলার প্রকৃতির মধুরস্পর্শ নেই। আগেই বলেছি দ্বিতীয় বিষয় হল প্রেম। যা নজরুলের গােপন প্রিয়া কবিতায় আছে। সৌন্দর্যবােধ তার অন্যান্য কবিতাতেও প্রতিফলিত। বিদ্রোহী কবিতায় বিদ্রোহের পাশাপাশি রােমান্টিক সত্ত্বার প্রকাশও ঘটেছে। যেমন –‘আমি উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাস পূরবী হাওয়া,’।

আরও পড়ুন-

ইসলামী সংস্কৃতির জয়-পরাজয়

ব্যক্তিগত জীবনের মতে প্রেমের আশ্বাস না পেলেও প্রেমিকাকে সৃজন করে নিতে চান। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে ‘তুমি তুমিই’ কিন্তু কবিমানসে প্রিয়া ‘নিখিল-রূপের রাণী—’। সবাই যখন তাঁকে নিয়ে কলরব করে কবি তখন তার স্তব রচনা করেন। একদিন কবি থাকবেন না, কিন্তু কবির গান থাকবে। আর সেই গান শুনে সকলে জিজ্ঞাসা করবে ‘কে সে কবির কাঁদিয়েছিল প্রাণ?’ তাছাড়া কবিকেও জিজ্ঞাসার সামনে পড়তে হবে। জানতে চাইবে মানসী প্রিয়া কে বা কোন্ জন ছিলেন?

মনের গােপন গহনে থাকা সেই প্রিয়াকে স্বর্গে পেতে চান না তিনি, পরিবর্তে তাকে মর্ত্য মাটির পৃথিবীতে পেতে চান।দেবী হিসাবে সেবা করতে চান না, তাকে মানবী হিসাবে চেয়েছেন। দেবীর দয়া অপেক্ষা প্রিয়ার আাঁখিজল কবির কাছে বেশি কাম্য। তাই প্রিয়াকে মাটির কুঠিরে মাটির প্রদীপ জবালা আহান জানিয়েছেন। কবির কথায় – ‘তুমি আমার বকুল যুঁথি –মাটীর তারা-ফুল, / ঈদের প্রথম চাঁদ গাে তােমার কানের পার্সি-দুল!’ কবির আঙিনায় ধরা না দিলেও কবি প্রেমের অহংকারে ঘােষণা করেছেন যে সুরের স্বয়ম্বর সভায় তাকে জয় করে নিয়েছেন। তার রূপের আলােতে কবির ভুবন মগ্ন। সে অপরের জন্য মালা গাঁথলেও কবির দুঃখ নাই। বরং কবির অহংকার কবি তার জন্য মালা গাঁথছেন। কিন্তু তার আগে বিদ্রোহী, পরিবর্তন, প্রতিষ্ঠান বিরােধীতা। আকাঙিক্ষত ইচ্ছা পুরণ না হলে কোন সমাজে, কোন পৃথিবীতে আমরা প্রিয়ার কোন মুখ দেখবাে। আগে মুক্ত পৃথিবী গড়াে, তারপর শ্বাস ভরে টানাে প্রাণ-মুক্তির হাওয়া।

বিশেষ করে তাঁর বহুল-চর্চিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার পরতে পরতে এমন একটা ভাবনা নিশ্চয় কাজ করেছিল। নজরুল একই সঙ্গে বিদ্রোহী রােমান্সভাবনার যুগল-কবি – এর মধ্যে কোন স্ববিরােধ থাকার না। কারণ রােমান্টিকতা বাস্তব বিচ্ছিন্ন কোনাে ঘটনা নয়। নজরুল চেয়েছেন অন্যায় উৎপীড়নের শেষে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হােক। তিনি তার কল্পনায় একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে চেয়েছেন। যে পৃথিবীতে বসবাসের ক্ষেত্রে মানুষের মনে কোনোে রাষ্ট্রীয় চাপ থাকবে না।

লেখকঃ কলাম লেখক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প  ও কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

আরও পড়ুন