Ads

দাম্পত্য জীবনে ফাঁটল ধরে যে কারণে

।। শহীদ সিরাজী ।।

পরিবার কথকথা নিয়ে কথা বলতে গেলে চলে আসে আদম হাওয়ার গল্প। নয় তা মোটেও আষাড়ে গল্প ! নির্ভেজাল সত্য গল্প। পরিবারের স্বামী ও স্ত্রী কি আদম-হাওয়া নন। এই স্বামী-স্ত্রীরা জীবনের প্রথম বেলায় থাকে টোনাটুনি। করে স্বপ্নের জাল বুনাবুনি কিন্তু সময়ের রোজনামচায় একসময় করে বসে খুনাখুনি। কিন্তু কেন?

কারণগুলো মন ও মননের ক্রিয়া-বিক্রিয়া কিংবা প্রতিক্রিয়ার ফল। বিয়ের সময় যে বর-কনেরা থাকে নিরীহ গৃহপালিতের মত; সময় বদলে যাওয়ার সাথে সাথে তারাও বদলে যেতে থাকে। আচরণ বদলে যেতে থাকে। বদলে যেতে থাকে চিত্রপট।

সুখী  ‘টোনাটুনি’ সম্পর্ক কে না চায়। শুধু চাইলে তো হবে না; এর জন্য প্রয়োজন পরস্পরের ভালবাসা শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বাস। এ সবই সুখী পরিবার গঠনের অন্যতম উপকরণ। তবে জীবন অংকে এ হিসাব কখনো কখনো পাল্টে যায়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা জীবনে ঝড় তোলে। শুরু হয় সম্পর্কের অবনতি। যা না দুজনের কেউ না আপনজন কেউ এমন আচরণ কামনা করে ।

যে সব কারণে মন বদলায় আচরণ বদলায় তার ফিরিস্তিও কম নয়। ঘটনার মধ্যে থাকে অঘটন, অনেক নাটকীয়তা। থাকে ছেলেমানুষি, মান-অভিমান, ম্যাড়মেড়ে স্বভাব, নড়বড়ে ব্যক্তিত্ব। থাকে তৃতীয়পক্ষের নাকগলানো। আরও কত কী। এ ব্যাপারে কিছু উদাহরণ তো দেয়া যেতেই পারে। যেমন-

দুনিয়া প্রেমের ফাঁদঃ

ফাঁদ বলতে আমরা অজানা বিপদকে বুঝি। দূনিয়াটা আসলে একটা ফাঁদই বটে। যেমন ফাঁদে পড়েছিলেন পৃথিবীর প্রথম মানুৃষ আদম (আ)। ইবলিস গন্দম নামের ফাঁদে ফেলেছিলেন তাঁকে। তবে হৃদয়ের পবিত্রতাতে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন।

পৃথিবীর মানুষ যারা পরিবার নামের নৌকায় চড়ছে; তারা কেউ ঋষি মনীষী বা দুনিয়া ত্যাগি নয়। তাদের চাই সম্পদ, অর্থ-বিত্ত। তবে যারা অল্পে তুষ্ট তাদের সমস্যা কম। লোভ যাদের লাগাম ছাড়া পরকাল ছেড়ে যারা দুনিয়ার সাথে পরকীয়া করতে চায় তাদের সংসারে ঘটে অঘটন। যখন স্বামীর লোভ বা অর্থের মোহ স্ত্রী মেনে নিতে পারে না। আবার স্ত্রীর চাই গাড়ি, বাড়ি, আর শাড়ি। তো প্রয়োজন অর্থ বিত্তের। তখন সে স্বামীকে চাপ দিতে থাকে। স্বামী বেচারা একপর্যায়ে মেনে নিতে পারে না। অতিষ্ট হয়ে উঠে। এতে ঘটে সম্পর্কের অবনতি।

প্ররোচিত হওয়াঃ

পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কখনো কখনো টক-ঝাল-মিষ্টির হলেও এটি থাকবে মজবুত ও স্থায়ী সম্পর্কের বাঁধনে। তবে পরিবেশে কখনো কখনো কোন পূর্বাভাষ ছাড়া নেমে আসে মেঘ-বৃষ্টি-ঝড়। কিছু মন্দ লোকের নষ্ট প্ররোচনায় দাম্পত্যে নেমে আসে দূর্যোগ। টুনাটুনির সংসারে তখন ঘটে যায় খুনাখুনির ঘটনা। বিস্ময়কর ব্যাপার! তবে এর কারণগুলো বিস্ময়কর নয়। দুজনের মাঝে তৃতীয়’র অনুপ্রবেশ ঘটলে এমন ঘটতে পারে। এটি হতে পারে মনের ইবলিস।

ধরুন, আপনারা টোনাটুনি পরিবার। প্রতিবেশী এক মহিলা সহ্য করতে পারছে না। তো, সে কৌশলে আপনার কাছাকাছি হলো। প্রবেশ করলো সুখের আঙিনায়।

কী কথার ঝলক তার; যেমন আন্তরিক তেমন সাজে পরম আপনজন। গল্পে গল্পে স্বামীকে স্ত্রীর বিরোধী করে তোলে। কখনোবা প্রতিবেশী ভাবির সুখের গল্প রচনা করে। আপনার সুখকে ছোট করে। স্বামীর প্রতি আপনার মনকে তিক্ততায় ভরিয়ে তোলে।

আবার কোন কোন প্রতিবেশী মহিলা বান্ধবীর সুখ দেখে হিংসায় কাতরায়। তখন কৌশলে মায়াজাল সৃষ্টি করে স্বামীর মনে ক্ষত সৃষ্টি করে। এর পরের স্টেজে শুরু হয় ভুল বোঝাবুঝি। বাড়তে থাকে পারিবারিক অশান্তি। এ সব কিন্তু সমাজ-পরিবারে অস্বস্তি সৃষ্টির বাস্তবতা।

আরও পড়ুন- তরুণদের বিয়ে ফ্যান্টাসি

পারস্পরিক উদাসীনতাঃ

প্রেমের সম্পর্কে থাকা আর বিয়ে করে সংসার করা পুরোটাই আলাদা। বিয়ের আগে প্রেমের সম্পর্ক যতই গভীর থাকুক না কেন, বিয়ের পর আবার শূন্য থেকেই সব শুরু করতে হবে। বিয়ের পর দু’পক্ষের অত্যাধিক আত্মবিশ্বাস আর উদাসীনতার জন্যই সম্পর্কে অবনতি দেখা দিতে পারে। আর হঠাৎ করেই ভেঙে যায় সাজানো সংসার।

দাম্পত্য জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মূলমন্ত্র ভালোবাসা। এই ভালোবাসার অভাব হলে সম্পর্কে সুখী হওয়া সম্ভব নয়। এভাবেই উদাসীনতা রোগের সৃষ্টি হয়। এটা উভয় পক্ষ থেকেই হতে পারে। যেমন-

ক. সম্মান না করা

বর্তমানে অনেক নারী হীনমন্যতায় ভোগে। আবার কিছু কিছু পুরুষ স্ত্রী ব্যাপারে উদাসীন। তার সম্মান দিতে চান না। এর ফলে স্ত্রীর মনে জমা হয় ক্ষোভের হিমালয়। তৈরি হয় হতাশা। এটি অনেক সময় বিচ্ছেদের পথে হাঁটে। এজন্য স্ত্রী স্বামীকে এবং স্বামী তার স্ত্রীকে প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে।

খ. সময় না দেওয়া

একসাথে থাকতে গেলে একে অপরকে সময় দেওয়াটা খুবই জরুরি। পরস্পরকে সময় না দিলে হাসিখুশি সম্পর্কও ভেঙে যেতে সময় লাগে না। যে নারীরা গৃহিনী, তাদের বেশিরভাগ সময়টাই বাড়িতেই কাটে। তখন স্ত্রীকে সময় না দেওয়ায় তাদের মনে তৈরি হয় এক বিরাট শূন্যতা। আর এই শূন্যতার জন্য সম্পর্কের রং ধীরে ধীর ফিকে হতে থাকে।

গ.​ অযথা রাগ দেখানো

কারো কারো মধ্যে অযথা রাগ দেখানোর অভ্যাস থাকে। আপনার এই অভ্যাসের জন্য আপনার সম্পর্ক ভেঙে যেতে পারে। তাই অযথা রাগ না দেখিয়ে তার সাথে শান্তশিষ্ট ব্যবহার করুন।

নবিজির, সাহাবাদের, সফল মনীষীদের দাম্পত্য জীবনের গল্প করতে হবে। প্রতিনিয়তই তা অনুশীলন করতে হবে। এর বিকল্প নেই।

ঘ. ঘনিষ্ঠতার অভাব 

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার জন্য শারীরিক ঘনিষ্ঠতা গুরুত্বপূর্ণ। এর অভাবে একাধিক জটিলতা তৈরি হতে পারে। এমনকি সংসার ভেঙে যেতে পারে। তাই পরস্পরের প্রতি শারীরিক আকর্ষণ বজায় রাখতে হবে। সময় থাকতে সম্পর্কের দিকে নজর দিতে হবে। ভালোবাসার দেয়া নেয়ার ভিতরেই দাম্পত্য জীবনের সফলতা নির্ভর করে। নইলে উল্টে যেতে পারে সংসার নামের নৌকাটা।

আরও পড়ুন-এক টুকরো জান্নাত

পরকীয়াঃ

যে ভাবেই বলা হোক না কেন পরকীয়া মানে বিষক্রিয়া। এটা করা মানে নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করা। ক্যানসারের মত ভয়ংকর ধ্বংসাত্মক রোগ। দাম্পত্য জীবন ধ্বংসের অন্যতম মাধ্যম। এ রোগ শুরুটা গোপনেই হয়। যদি কোন না কোন ভাবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শূন্যতা তৈরি হয় তাহলে এটা হতে পারে। একের প্রতি অন্যের উদাসীনতা থেকে দূরত্ব তৈরী হয় তা থেকে পরকীয়া পথ খুঁজে নিতে পারে। দম্পতি

মনোদৈহিক ও সামাজিক কারণে এমন হতে পারে। যৌনচাহিদা পূরণ না হওয়া থেকেও হতে পারে। অনেকে মনে পশ্চিমা সংস্কৃতির ধাঁচের সংস্কৃতি লালন করে। তার প্রসারও চায়। এদের ভেতরে কেউ কেউ সাহসি হয়েও পরকীয়ায় জড়াতে পারে। কোন কোন সঙ্গীর নানাবিধ অতিরিক্ত চাহিদা থাকে এটা তাকে পরকীয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

স্বামী বা স্ত্রীর কেউ যদি দীর্ঘসময় দূরে থাকে বা অন্য কারোর সাথে মোলমেশা করে তাতেও এ রোগ ছড়াতে পারে। মিডিয়াও এ ব্যাপার ভূমিকা রাখে। সমাজে বা পরিবারে পরকীয়ার প্রবণতা তৈরি করে। কারো গোপনে পর্নোসাইট দেখার অভ্যাস থাকলে তার পরকীয়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি হতে পারে। স্বামী-স্ত্রী দূরে থাকলেও এ সমস্যা আরও বাড়তে পারে। দম্পতির ভেতরে কেউ শ্লাঘায় ভুগলে বা নিজের স্ট্যাটাস বাড়ানোর রোগ থাকলে সে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়তে পারে। অনেকের মানসিক অশান্তি দূর করতে অন্যের সংগে সমস্যা শেয়ার করে। এমন শেয়ার করতে করতে একসময় পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়তে পারে।

লোভঃ

এক ভয়ানক ব্যাধির নাম লোভ । সমাজ নামের নাট্যমঞ্চের কুশিলব যারা তাদের ছেলে ও মেয়ে মিলে নির্মাণ করে সুখের নীড়। এ নীড় রচনায় বাবুই পাখির মত তার সংগ্রহ করে খড়কুটো। তবে যাদের বোধকে আক্রান্ত করেছে লোভ ; তাদের নীতিবোধে চিড় ধরে। নিজের মত করে ভাবে। লোভের নৌকায় চড়ে বসে। তাতে কখনো কখনো ঘটে ছন্দপতন।

অহমঃ

অহমে পড়ে কখনো কখনো কেউ কেউ নিজেদের প্রতি বেরহম হয়ে পড়ে। এটা একট গোপন রোগ। বিয়ের আগে বা একটা সময় পর্যন্ত বহাল তবিয়তে গা ঢাকা দিয়ে থাকে। সময় হলে গোখরো সাপের মত ছোবল মারে বা মারতে চায়। অবশ্য একজন অন্যজনকে সম্মান না দেয়া থেকে হতে পারে। হতে পারে এটা মজ্জাগত। নিজের মতকে ঠিক মনে করা

অন্যের মত না শোনা ; এসব বিষয়ই এর ক্যাটালিস্ট। তো আপনাদের টুনাটুনির সংসারকে টেকাবেন কি করে? নিশ্চয় স্টারজলসা বা স্টারপ্লাস টিভি সিরিয়াল দেখে নয়। নারীরা মা খাদিজার জীবনী পড়ে শিক্ষা নিতে পারেন। তিনি একজন ধনাঢ্য মহিলা হয়েও অহংকার তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। পুরুষদেরও তেমনি নবিজির জীবনী থেকে দাম্পত্য জীবনের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।

লেখকঃ  কবি , সাহিত্যিক এবং  সাবেক এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প, কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক!  আপনি আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ;  মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই ।  আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

আরও পড়ুন