Ads

একাকী জয়ের প্রবণতা বনাম সম্মিলিত বিজয়ের গুরুত্ব!

।। ড. মোহাঃ ইয়ামিন হোসেন ।।

বাঙালী জাতির একটি বড় সমস্যা হলো একাই জিততে চাওয়ার প্রবণতা। এটি আমাদের সমাজের বিভিন্ন স্তরে, ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে, এমনকি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান। ব্যক্তিগত অর্জন ও একক সাফল্যের পেছনে ছুটে আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে, সত্যিকারের স্থায়ী বিজয় একা অর্জন করা সম্ভব নয়; বরং সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সহযোগিতার মাধ্যমেই তা সম্ভব।

এখানে তিনটা গল্প খরগোশ ও কচ্ছপের কাহিনী দিয়ে তুলে ধরলাম। ৪/৫ মিনিট সময় লাগবে, কিন্তু এই গল্প থেকে জীবনের লক্ষ্যগুলো এখন থেকে নতুন করে সাজানোর শক্তি পাবে।

প্রথম গল্প: কচ্ছপ খরগোশকে হারাবে

গল্প:

একদিন খরগোশ আর কচ্ছপের মধ্যে এক দৌড় প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ হল। খরগোশ খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে সে কচ্ছপকে সহজেই হারাতে পারবে কারণ সে দ্রুত গতিতে দৌড়াতে পারে। অন্যদিকে কচ্ছপ খুবই ধীর কিন্তু স্থির ও একাগ্র ছিল।

দৌড় শুরু হলে খরগোশ দ্রুত দৌড়াতে শুরু করল এবং শীঘ্রই কচ্ছপকে অনেক পেছনে ফেলে দিল। খরগোশ এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে সে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার জন্য একটি গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়ল। অন্যদিকে, কচ্ছপ ধীরে ধীরে কিন্তু অবিরাম গতিতে চলতে লাগল। সে থামল না, ক্লান্ত হলো না।

কিছুক্ষণ পর, কচ্ছপ খরগোশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলতে থাকল এবং অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছে গেল। যখন খরগোশ ঘুম থেকে জেগে উঠল, সে দেখল যে কচ্ছপ ইতিমধ্যে দৌড় শেষ করে বিজয়ী হয়েছে। খরগোশ হতাশ হল এবং বুঝতে পারল যে তার অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও অলসতা তার পরাজয়ের কারণ হয়েছে।

কচ্ছপ খরগোশকে হারায়

শিক্ষণীয় বিষয়:

এই গল্পটি আমাদের শেখায় যে ধৈর্য, একাগ্রতা এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সবকিছু অর্জন করা সম্ভব। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এবং অলসতা কখনোই সাফল্য এনে দেয় না। নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা এবং নিয়মিত পরিশ্রমই প্রকৃত বিজয়ের পথে নিয়ে যায়। এই গল্প থেকে আমরা শিখি যে, ধীরগতিতে হলেও স্থির ও স্থায়ী প্রচেষ্টা সাফল্য এনে দিতে পারে।

দ্বিতীয় গল্প: খরগোশ জিতবে

গল্প:

খরগোশ এবং কচ্ছপ আবার একটি দৌড় প্রতিযোগিতার জন্য চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল। এবার খরগোশ তার পূর্ববর্তী পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে খুব সতর্ক এবং প্রস্তুত ছিল। সে জানতো যে অলসতা এবং অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস তার পরাজয়ের কারণ হয়েছিল।

প্রতিযোগিতা শুরু হলে, খরগোশ আবারও দ্রুত দৌড়াতে শুরু করল, কিন্তু এবার সে এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্রাম নিল না। সে কচ্ছপকে পেছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে গেল এবং নিজের গতিতে কোন ছেদ না এনে দৌড়াতে থাকল। অন্যদিকে, কচ্ছপ তার নিজের স্বাভাবিক গতিতে চলতে থাকল, কিন্তু খরগোশের গতির সাথে তাল মিলাতে পারল না।

বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় আগ্রহীদের জন্য করণীয়

খরগোশ অবশেষে প্রথমে দৌড় শেষ করল এবং বিজয়ী হল। কচ্ছপ ধীরে ধীরে গন্তব্যে পৌঁছালো এবং খরগোশের জয়ের জন্য তাকে অভিনন্দন জানালো। খরগোশ খুশি ছিল যে সে এবার তার ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বিজয় অর্জন করতে পেরেছে।

শিক্ষণীয় বিষয়:

এই গল্পটি আমাদের শেখায় যে সঠিক প্রস্তুতি এবং মনোযোগ দিয়ে কাজ করলে যে কোন কঠিন কাজ সহজে সম্পন্ন করা সম্ভব। প্রতিযোগিতায় জিততে হলে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ও একাগ্রতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিক পথে এগিয়ে গেলে সাফল্য আসবেই। আমরা শিখি যে নিষ্ঠা এবং পরিশ্রমই প্রকৃত সাফল্যের চাবিকাঠি।

খরগোশ জিতে যায়

তৃতীয় গল্প: খরগোশ ও কচ্ছপ উভয়ই একসাথে জিতবে

গল্প:

একদিন খরগোশ এবং কচ্ছপ একটি বিশেষ প্রতিযোগিতার জন্য চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল। এই প্রতিযোগিতায় শুধু দৌড় নয়, রাস্তা ও নদী পার হতে হবে। তারা ঠিক করল যে তারা একসাথে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে এবং পরস্পরকে সাহায্য করবে।

প্রতিযোগিতা শুরু হলে, খরগোশ কচ্ছপকে তার পিঠে তুলে নিয়ে দ্রুত গতিতে দৌড়াতে শুরু করল। কিছুদূর যাওয়ার পর খরগোশ ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তখন কচ্ছপ খরগোশকে তার পিঠে তুলে নিলো এবং তাকে বিশ্রাম নিতে সাহায্য করল। তারা এভাবে একে অপরকে সাহায্য করে রাস্তা পার হল।

ভাল ক্যারিয়ার গঠনে করণীয়

তারপর তারা নদীর কাছে পৌঁছালো। খরগোশ ভালো সাঁতার জানত না, কিন্তু কচ্ছপ সাঁতারে পারদর্শী ছিল। তাই কচ্ছপ খরগোশকে তার পিঠে তুলে নদী পার করল। খরগোশও কচ্ছপকে সাহায্য করল যেভাবে সে পারে।

এভাবে, তারা একে অপরকে সাহায্য করে, রাস্তা এবং নদী পার হয়ে গন্তব্যে পৌঁছালো। তারা উভয়েই বিজয়ী হল এবং তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা আরও মজবুত হল।

খরগোশ ও কচ্ছপ উভয়ই একসাথে জিতে যায়

শিক্ষণীয় বিষয়:

এই গল্পটি আমাদের শেখায় যে সহযোগিতা এবং বন্ধুত্বের মাধ্যমে অনেক বড় কাজ সহজে সম্পন্ন করা সম্ভব। প্রতিযোগিতার পরিবর্তে পরস্পরের প্রতি সাহায্য এবং সহযোগিতা প্রদর্শন করলে উভয় পক্ষই লাভবান হয়। একে অপরের দুর্বলতা পূরণ করে সহযোগিতা করলে যে কোন কাজ সহজে এবং দ্রুত সমাধান করা যায়। এই গল্প থেকে আমরা শিখি যে সহযোগিতাই প্রকৃত সাফল্যের মূলমন্ত্র।

এই তিনটি গল্পের মাধ্যমে আমাদের শেখায় যে সাফল্য অর্জনের জন্য ধৈর্য্য, কঠোর পরিশ্রম, সঠিক প্রস্তুতি এবং সহযোগিতার প্রয়োজন। প্রতিটি গল্পে একটি মূল্যবান শিক্ষা রয়েছে যা আমাদের জীবনে প্রয়োগ করলে আমরা আরও সফল হতে পারি।

বিস্তারিত বিশ্লেষণ:

প্রথম গল্প: ধৈর্য্য ও একাগ্রতার গুরুত্ব

প্রথম গল্পে কচ্ছপের জয় আমাদেরকে ধৈর্য্য এবং একাগ্রতার মূল্য বুঝতে সাহায্য করে। এই গল্পটি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যেমন শিক্ষাক্ষেত্রে, পেশাগত জীবনে এবং ব্যক্তিগত লক্ষ্য অর্জনে। আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করি যে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য অর্জনে ধৈর্য্য এবং স্থায়ী প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কচ্ছপের দৃষ্টান্ত আমাদের শেখায় যে কোন কাজেই হোক না কেন, স্থায়ী এবং ধারাবাহিক প্রচেষ্টাই শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়।

বিদেশে এমএস বা পিএইচডির জন্য এসওপি লেখার নিয়ম

দ্বিতীয় গল্প: নিষ্ঠা ও প্রস্তুতির গুরুত্ব

দ্বিতীয় গল্পে খরগোশের জয় আমাদেরকে নিষ্ঠা এবং সঠিক প্রস্তুতির গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করে। এই গল্পটি আমাদের শেখায় যে যে কোন কাজে সফল হতে হলে পূর্ণ মনোযোগ এবং সঠিক প্রস্তুতির প্রয়োজন। খরগোশের জয় থেকে আমরা শিখি যে শুধুমাত্র ক্ষমতা বা দক্ষতা নয়, বরং তার সাথে সঠিক প্রস্তুতি এবং একাগ্রতাই সাফল্যের মূলমন্ত্র।

তৃতীয় গল্প: সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের শক্তি

তৃতীয় গল্পে খরগোশ এবং কচ্ছপের যৌথ বিজয় আমাদেরকে সহযোগিতা এবং বন্ধুত্বের শক্তি সম্পর্কে সচেতন করে। আমরা প্রায়ই জীবনে লক্ষ্য করি যে একা একা কোন কাজ সম্পন্ন করা কঠিন হতে পারে, কিন্তু সহযোগিতা এবং দলবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সেই কাজ সহজ হয়ে যায়। এই গল্প থেকে আমরা শিখি যে পরস্পরকে সাহায্য করে, সহযোগিতা করে যে কোন কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব।

এই তিনটি গল্পের শিক্ষণীয় বিষয়গুলি আমাদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ধৈর্য্য, একাগ্রতা, সঠিক প্রস্তুতি, নিষ্ঠা এবং সহযোগিতা আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রে সাফল্য এনে দিতে পারে। এই গল্পগুলি আমাদেরকে জীবনের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মূল্যবান শিক্ষা প্রদান করে এবং আমাদেরকে আরও সফল ও সুখী হতে সাহায্য করে।

বাঙালী জাতির একাকী জয় অর্জনের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। স্থায়ী এবং সত্যিকারের সাফল্য অর্জনের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমাজ, প্রতিষ্ঠান এবং জাতিকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিতে সম্মিলিত বিজয়ের মানসিকতা গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। এভাবে আমরা শুধু ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং সমগ্র সমাজের মঙ্গল ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারব। মহান আল্লাহ সকলকে ধৈর্য্য, একাগ্রতা, সঠিক প্রস্তুতি, নিষ্ঠা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে জীবনের সব ক্ষেত্রে সাফল্য বয়ে আনার তৌফিক দান করুন। আমিন ইয়া রব্বুল আলামীন।

লেখকঃ প্রাবন্ধিক এবং অধ্যাপক, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় 

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প  ও কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

ফেসবুকে লেখক  মোঃ ইয়ামিন হোসেন 

আরও পড়ুন