Ads

ইসলামী সংস্কৃতির জয়-পরাজয়

।। শহীদ সিরাজী।। 

‘সংস্কৃতি’ আমাদের সমাজে একটা বহুল প্রচলিত শব্দ। সংস্কৃতির কথা বলতেই আমরা বুঝে থাকি গান-বাজনা-নাচকে। নাটক-থিয়েটারকে বুঝি। মূলত বিনোদনকেই এখানে সংস্কৃতি বলা হচ্ছে। আসলে কি তাই? এসব সংস্কৃতির অংশ তবে এই কয়েকটা কাজই কেবল সংস্কৃতি নয়। বলা যায় এগুলো সামগ্রিক সংস্কৃতির একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।

সাংস্কৃতি কি?

সংস্কৃতি’ শব্দটি এসেছে ইংরেজি শব্দ Culture থেকে। culture শব্দটি আবার এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘Colere’থেকে। যার অর্থ ‘চাষ’। কখনো কখনো Culture শব্দের অর্থ করা হয়েছে; ‘The training and refinement of mind, taste and manners’. এর অর্থ- পরিশীলিত মন, মার্জিত রুচি ও ব্যবহার। বলা হয়েছে, মানুষ যা করে তাই সংস্কৃতি। তাদের আচার-ব্যবহারই সংস্কৃতি। মানুষ যেভাবে জীবনযাপন করে তার পূর্ণ চিত্র হলো সংস্কৃতি। প্রতিদিন আমরা যে কাজ করি তার যোগফল হলো সংস্কৃতি।

অন্যভাবে বলা যায়, সংস্কৃতি হলো শিক্ষা বা অভ্যাস দ্বারা লব্ধ কৃষ্টি। শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে দাড়ায়- সম্-কৃ (করা)+ ক্তি। এর মধ্যে নিহিত আছে যেসব বিষয় তা হল পরিশীলিত, পরিমার্জিত পরিশ্রুত, নির্মলীকৃত শোধিত ধরনের অনুভবসমূহ। অর্থাৎ উৎকর্ষময় বা পরিশ্রুত জীবন চেতনাই সংস্কৃতির সার কথা।

আমাদের বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিতে সংস্কৃতি 

* ডঃ আহমদ শরীফের মতে -সংস্কৃতি হল মানুষের অর্জিত আচরণ, পরিশুদ্ধ জীবন-চেতনা।

* তাজুল ইসলাম হাশেমীর মতে-চিন্তায়, কর্মে ও আচরণে জীবনের সুন্দর, শোভন, পরিশীলিত ও পরিমার্জিত অভিব্যক্তিই সংস্কৃতি।

* মোতাহার হোসেন চৌধুরী বলেন,সত্যকে ভালোবাসো, সৌন্দর্যকে ভালোবাসো, ভালোবাসাকে ভালোবাসো, বিনা লাভের আশায় ভালোবাসো, নিজের ক্ষতি স্বীকার করেভালোবাসো- এরি নাম সংস্কৃতি। তাঁর মতে সংস্কৃতির অনিবার্য শর্ত হচ্ছে মূল্যবোধ।

* বদরুদ্দিন ওমরের মতে, ‘জীবন চর্চারই অন্য নাম সংস্কৃতি। মানুষের জীবিকা, তার আহার-বিহার, চলাফেরা, তাঁর শোকতাপ, আনন্দ বেদনার অভিব্যক্তি, তার শিক্ষা-সাহিত্য, ভাষা, তার দিন-রাত্রির হাজারো কাজকর্ম, সব কিছুরই মধ্যেই তার সংস্কৃতির পরিচয়।

পাশ্চাত্য মনীষীদের দৃষ্টিতে সংস্কৃতি 

* মনীষী ডিউই বলেন,”Culture means at least something cultivated. something ripened. It is opposite to the raw and crude. অর্থাৎ সংস্কৃতি বলতে বুঝায় এমন কিছু যার অনুশীলন করা হয়েছে, যা পূর্ণতা লাভ করেছে। যা হচ্ছে অমার্জিত ও অপরিণতের পরিপন্থী।

* টেইলর বলেন, “Culture is the complex -whole which includes knowledge belief, art, moral, law, custom and any other capabilities and habits aquaguard by men as a member of society.”অর্থাৎ সংস্কৃতি হলো সমাজের মানুষের অর্জিত জ্ঞান, বিশ্বাস শিল্পকলা, নেতিক আইন, প্রথা, সংস্কার ও অন্যান্য বিষয়ে জটিল সমাবেশ।

* রাশিয়ান চিন্তাবিদ ট.ভি.ডি রবার্টির মতে,সংস্কৃতি হলো অনুমানগত ও ফলিত সব চিন্তাধারা ও জ্ঞানের সমষ্টি। গ্রাহাম ওয়ালেসের মতে, সংস্কৃতি হলো, চিন্তাধারা, মূল্যবোধ ও বস্তুর সমষ্টি, এক কথায় সামাজিক ঐক্য।

আরও পড়ুন-

যৌন হয়রানির প্রতিরোধ কোন পথে?

* আর, বি. মালিনওস্কির মতে,সংস্কৃতি হলো, মানুষের ক্রমবর্ধমান সৃষ্টির সমষ্টি। রবার্ট রেডফিল্ড বলেছেন, সংস্কৃতি হলো সমগ্রভাবে ‘সমঝোতাসমূহের অংশ।’

* র‌্যাডক্লিফ ব্রাউনের মতে,সংস্কৃতি মূলতই একটি ‘নিয়ম কানুনের ধারা’।

* নৃবিজ্ঞানী ফ্রাঞ্জ বোয়াসের মতে -‘সমাজের প্রচলিত আচার -অনুষ্ঠান এবং এই বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতি ব্যক্তিবিশেষের যে প্রতিক্রিয়া, এই দুইয়ের সংমিশ্রণে যা সৃষ্টি হয় তাই সংস্কৃতি।

* ম্যালিনোস্কির মতে –

‘সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের আপন কাজের সৃষ্টি, যার মাধ্যমে সে তার উদেশ্য সাধন করে।’

* লোয়ির মতে -‘সংস্কৃতি একটি বংশগত উপাদান। এটি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যায়। একটি স্বতন্ত্র লোক তার সমাজ থেকে যে বিশ্বাস, রীতি, কলাকৌশল, খাদ্যভাস ও দক্ষতা লাভ করে তার সমষ্টিকে আমরা সংস্কৃতি বলে জানি। এগুলো তার নিজের সৃষ্টি না, বরং শিক্ষার মাধ্যমে অতীত থেকে উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া বস্তুর মতো তার কাছে এসেছে।’

উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞা-

“Culture is a concept that encompasses the social behavior, institutions, and norms found in human societies, as well as the knowledge, beliefs, arts, laws, customs, capabilities, and habits of the individuals in these groups. Culture is often originated from or attributed to a specific region or location.”

উপরে সংস্কৃতির অনেকগুলো সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো। এগুলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই সংস্কৃতি হলো শিক্ষা বা অভ্যাস দ্বারা লব্ধ কৃষ্টি। পরিশীলিত, পরিমার্জিত পরিশ্রুত, নির্মলীকৃত শোধিত ধরনের অনুভবসমূহ। অর্থাৎ উৎকর্ষময় বা পরিশ্রুত জীবন চেতনাই সংস্কৃতি। আসলে ‘মানুষ যা করে তাই সংস্কৃতি। মানুষের ভাষা, কলা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, আইন, দর্শন, রাষ্ট্র, নৈতিকতা, ধর্ম- এসবই সংস্কৃতির আওতায় পড়ে। সংস্কৃতি একটি ব্যাপক বিষয় এবং এর পরিষরও অনেক বিস্তৃত। বলা যায় মানুষের সামগ্রিক অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্য জীবনাচারের অপর নাম সংস্কৃতি। মূল্যবোধ এর অপরিহার্য পূর্বশর্ত। বিশ্বাসই এর মূলভিত্তি।

মানুষ সামাজিক প্রাণী। সমাজবদ্ধভাবে তাদের বসবাস করতে হয়। এজন্য সকলে নিজেদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের আলোকে কাজ করে থাকে। এভাবেই তারা যা যা করে তাই সংস্কৃতি হয়ে যায। তাদের কাজ-আচরণ এমনকি কাজের ব্যবহারের সামগ্রী সংস্কৃতির আওতায় এসে যায়। মানুষের সৃষ্টি সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, আইন-কানুন এসবও। মানুষের প্রাত্যহিকতার সকল কাজই সংস্কৃতির অংশ।

আমাদের দেশে সংস্কৃতি কথাটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে বিনোদনকেই সংস্কৃতি মনে করা হয়। গান, বাজনা, নাচ, অভিনয়। আর যারা এসব করে তারাই সংস্কৃতিকর্মী। যারা নাটক-থিয়েটার করে তারাও সাংস্কৃতি কর্মী। আসলে তা নয়। এই কয়টা কাজই সংস্কৃতি নয় বরং সামগ্রিক সংস্কৃতির একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।

ইসলামী সংস্কৃতি 

ইসলামি সংস্কৃতি বলতে কি বুঝায ? এ উপমহাদেশের একজন প্রথিতযশা মনীষী বলেছেন, যাকে ‘সংস্কৃতি’ বলা হবে, তার পাঁচটি মৌলিক উপাদান থাকতে হবে। –

(১) দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে ধারণা

(২) জীবনের চরম লক্ষ্য

(৩) মৌলিক আকীদা ও চিন্তাধারা

(৪) ব্যক্তিপ্রশিক্ষণ এবং

(৫) সমাজব্যবস্থা।

আরও সহজ ভাবে বলা যায়, যে সংস্কৃতি থেকে দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্য, মৌলিক আকিদা ও চিন্তাধারা প্রকাশ ঘটে, সমাজব্যবস্থাতেও তার পূর্ণ প্রকাশ ঘটে তা’ই ইসলামী সংস্কৃতি। মানবজাতির সেই সকল জীবনাচার যা ইসলাম অনুমোদন করে। এর ফোকাস পয়েন্ট মূল্যবোধ। তাই ইসলামী মূল্যবোধের পরিপন্থী সকল জীবনাচারই ইসলামে অপসংস্কৃতি।

সেই হিসেবে অপসংস্কৃতি তালিকায় থাকবে সুদ গ্রহণ, ঘুষ খাওয়া, মদপান করা, জুয়া খেলা ইত্যাদি। ব্যভিচার, লিভ টুগেদার বা বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, ইভটিজিং এসবও অপসংস্কৃতি। মুসলিম সমাজে এসব যতই প্রচলিত থাক না কেন তবু তা অপসংস্কৃতি।

অন্যদিকে, সত্যবাদিতা, শালীনতা, মেহমানদারী, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা, পরোপকার করা ইত্যাদি যদি অমুসলিম সমাজেও প্রচলিত থাকে তবু তাকে ইসলামি সংস্কৃতি বলতে হবে। সুতরাং পরিশীলিত, পরিমার্জিত, পরিশ্রুত , নির্মলীকৃত শোধিত ধরনের অনুভব যা ইসলাম অনুমোদিত তাই ইসলামী সংস্কৃতি।

আরও পড়ুন-

দাম্পত্য জীবনে ফাঁটল ধরে যে কারণে

ধর্ম ভেদে সংস্কৃতি 

সংস্কৃতির সংজ্ঞাতে যত ভালো ভালো কথা বলা হোক না কেন আর উদ্দেশ্য যতই কল্যাণকর বলা হোক না কেন স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কিংবা ধর্মভেদে তা কিন্তু পরিবর্তিত হয়ে যায়। বদলে যায় আচার-আচরণ, কর্মকাণ্ড। কর্মসূচিতে ব্যত্যয় ঘটে। যেমন ইসলামে মূর্তিপূজা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মূর্তিপূজা নির্মূলের জন্য ইসলামের আগমন ঘটেছে। কিন্তু হিন্দুধর্মে এটিই বড় ধর্মাচার। মুসলমানরা এক আল্লাহতে বিশ্বাসী হলেও খ্রিস্টানরা তৃত্ববাদে বিশ্বাসী আর হিন্দুরা বহু ঈশ্বরের বিশ্বাসী।

এখন কেউ যদি বলে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ তাহলে সকল ধর্মের লোক কি তা মানবে? মুসলমানদের ঈদে হিন্দু কিংবা খ্রিস্টানরা কি নামাজ আদায় করবে? আবার হিন্দুদের পূজা উৎসবে কি ধর্মপ্রাণ কোনও মুসলমান যোগ দিবে? মুসলিমদের কুরবানি উৎসবে পশু জবাই করা হয় আর হিন্দুরা তাদের উৎসবে বলিদান করে। এক ধর্মের লোকের উৎসব অন্য ধর্ম কি মেনে নেয়? ‘ধর্ম যার যার উৎসবও কেবল তারই, অন্য কারো নয়’। মূলত এটিই সংস্কৃতি; এর বাইরে যা কিছু ঘটে তা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে করা হয় যেটা সংস্কৃতি নয়। চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতি।

সংস্কৃতিতে আর যাই থাক, থাকতে পারবে না অনাচার। শোষণ-নিপীড়ন, নির্যাতন, দুঃশাসন এসবেরও কোন স্থান নেই সংস্কৃতিতে। কোন সংস্কৃতিবান মানুষ অমানবিক কাজ করতে পারে না। এই থাকা না থাকা দিয়েই সংস্কৃতির জয় ও পরাজয় নির্ধারিত হয়।

ইসলামী সংস্কৃতির জয় ও পরাজয় 

মুসলিম সংস্কৃতিতে প্রতিদিন মূল্যবোধের চর্চা বা অনুশীলন হচ্ছে। বলা হয়েছে মানুষ যা করে তাই সংস্কৃতি ; তো মুসলমানরা প্রতিদিন কি করে? তাদের প্রাত্যহিকতা হচ্ছে নামাজ পড়া, কুরআন তেলাওয়াত করা, জ্ঞান চর্চা করা, হালাল উপার্জন করা, দান-সদকা করা, সত্য কথা বলা, মিথ্যা পরিহার করা, দুর্বলকে সহযোগিতা করা, বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, মানুষকে ইসলামের পথে আহ্বান করা ইত্যাদি। এছাড়া তারা নিজেরা অন্যায় করে না; কেউ অন্যায় করলেও তাকে বাধা দেয়। এভাবে ইসলামের বিধি-বিধান মেনে তাদের প্রাত্যহিকতায় সংস্কৃতির জয় নিশ্চিত করে।

বাস্তবে বিষয়টা সম্পূর্ণ উল্টো। জর্জ বার্নার্ড’ শ একবার বলেছিলেন, ‘ইসলাম হচ্ছে শ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং মুসলমানরা হচ্ছে সর্ব নিকৃষ্ট আনসারী’। দুর্ভাগ্যজনক হলেও গ্লোবাল ইকোনমি জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় সে কথায় বলে। ইসলামিক দেশগুলি কতখানি ইসলামিক এ নিয়ে গবেষণা করেন জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হুসেন আসকারী। গবেষণায় দেখা গেছে সবচেয়ে ইসলামিক বিধান মেনে চলা দেশ সৌদি আরব বা কোনও মুসলিম দেশ নয় বরং অমুসলিম দেশ নিউজিল্যান্ড এবং দ্বিতীয় অবস্থানে লুক্সেমবার্গ। তারপর এসেছে পর্যায়ক্রমে আয়ারল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক ষষ্ঠ ও কানাডা সপ্তম অবস্থানে। মালয়েশিয়া ৩৮তম, কুয়েত ৪৮তম, বাহরাইন ৬৪তম, এবং সৌদি আরব ১৩১তম অবস্থানে। আর বাংলাদেশের অবস্থান আরও পরে ।

গবেষণায় আরো দেখা গেছে মুসলমানরা কুরআন তেলাওয়াত, হাদিস পাঠে বেশ মনোযোগী। নামাজ, রোজা, হিজাব, দাড়ি, লেবাস এসবেও বেশ আন্তরিক। তবে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে ইসলামের আইন মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। তাছাড়া বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রনয়কেরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বা ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়নি। তাই মুসলিম দেশ হয়েও সেরা মুসলিম রাষ্ট্র হতে পারেনি।

এখানেই এসে যায় সংস্কৃতির জয়-পরাজয় কথাটি। গ্লোবাল ইকোনমি জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার রিপোর্টে এমন হওয়ার এটি অন্যতম কারণ হতে পারে। আমরা নবিজির সময়ে ও খোলাফায়ে রাশেদের যুগে কি দেখি? তখন ইসলামী সংস্কৃতি চর্চা ও ইসলামী রাষ্ট্র বাস্তবায়নের পূর্ণচিত্র কি আমরা দেখতে পাই না? অপসংস্কৃতি বা নষ্ট সংস্কৃতি হটিয়ে তখন তো ইসলামী সংস্কৃতির পূর্ণ বিজয় হয়েছিল।

আরও পড়ুন-

ইসলামী সংস্কৃতির ভিতর বাহির

ইসলামী সংস্কৃতির পরাজয় কেন ?

জয় কিংবা পরাজয় কথাটি আসে কোনও প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা যুদ্ধের পরে। সাংস্কৃতির জয় কিংবা পরাজয়ের ব্যাকগ্রাউন্ডে রয়েছে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। এটি একটি ভয়াবহ যুদ্ধ। আমাদের দেশে এমনকি গোটা বিশ্বের মুসলিম দেশে চলছে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ।

এ যুদ্ধের মূল লক্ষ্য মুসলিমদেরকে তাদের সংস্কৃতি চর্চা করতে না দেয়া বা প্রকৃত মুসলিমরূপে বাঁচতে না দেয়া। এ যুদ্ধ হচ্ছে এতই কৌশলে যে আমরা টের পাচ্ছি না। আগে মৌলবাদ নির্মূলের নামে চলেছে ইসলাম নির্মূল অভিযান। এখন মূলত ইসলামের দর্শন, রীতিনীতি ও মূল্যবোধকে তারা দুর্বল করতে বা ধ্বংস করতে চায়।

অবশ্য, এই যুদ্ধটা সব সময় দৃশ্যমান নয়। গোপন এজেন্ডার মাধ্যমে বাস্তবায়ন চলছে। চলছে সমাজে পাপাচার ছড়িয়ে দিয়ে। তাছাড়া অবিচার, খুন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস তথা দুর্বৃত্তির পথে দেশকে চালিয়েও চলছে সে কাজ। এছাড়া রয়েছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। নানা অনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে তাদের নৈতিকতাকেও ধ্বংস করা হচ্ছে। নানা উপায়ে অন্য আদর্শ যেমন সেক্যুলারিজম, কম্যুনিজম, জাতীয়তাবাদ ও হিডোনিজম তথা ভোগবাদে উদ্বুদ্ধ করার সমস্ত কৌশল প্রয়োগ করাও হচ্ছে। সমাজে এই যুদ্ধ চলমান। সাংস্কৃতিক অঙ্গন গোপন রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছে। যেমন তাদের বাহিনি তেমন শয়তানি কূটকৌশল। ফ্রন্টলাইনও তাদের দখলে। দেশের মিডিয়া-টিভি চ্যানেল তাদের দখলে। শিক্ষা-সংস্কৃতি সাহিত্যের অঙ্গন সব জায়গাকে তারা ব্যবহার করছে। বিশাল প্রকাশনা জগতের যত প্রকাশনা তার প্রায় ৯৫ শতাংশ লেখক তারা।

এছাড়া, আলেম সম্প্রদায় যারা ইসলামের পথ বা ইসলামী সংস্কৃতি চর্চার পথ দেখানোর জন্য দায়বদ্ধ তাদেরকে নানা কৌশলে নানা দলে বিভক্ত করে রাখা হচ্ছে। মাসলা-মাসায়েল ছাড়া বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানচর্চাতে তারা অনুপস্থিত।

পত্র-পত্রিকা ও টিভি নেটওয়ার্কের প্রায় সবগুলোর মালিক তারাই। এখন দেশবাসীর ঘরে ঘরে অবিরাম নাস্তিকতার বুলেট বর্ষণ করছে। এভাবেই দেশে পরাজিত হচ্ছে ইসলাম, পরাজিত হচ্ছে ইসলামী সংস্কৃতি।

সাংস্কৃতিক যুদ্ধের পরাজয়ের আরও কিছু চিত্র 

অপসংস্কৃতির কর্মসুচি 

সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নাস্তিক্যবাদী, ভোগবাদী সংস্কৃতির ব্যাপক চর্চা চলছে। নববর্ষ, বিশ্ব ভালবাসা দিবস, বসন্তবরণ, থার্টিফার্স্ট নাইট নামে প্রতিবছরই দেখা যাচ্ছে নষ্ট সংস্কৃতির চর্চা। আধুনিকতার নামে এ সবের মাধ্যমে তারা অশ্লিলতা ছড়িয়ে  দিচ্ছে। তরুণ তরুণীদের উন্মাতাল নৃত্য-গীত, ডিজে পার্টি, মাদকের নীল ছোবল, অবাধ যৌনাচারে ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দৃশ্যপট। কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের বলা হচ্ছো প্রতিক্রিয়াশীল বা মৌলবাদী। যে সমস্ত কাজ ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ তা এখন মহাসাড়ম্বরে করা হচ্ছে। কোনও বাঁধা নেই, নেই কোন জবাবদিহিতাও! এভাবে গোপন যুদ্ধে অপসংস্কৃতির জয় হচ্ছে, ইসলামী সংস্কৃতির হচ্ছে পরাজয়।

পাড়া-মহল্লার নষ্ট পরিবেশ 

ইসলামী সংস্কৃতির চর্চা শুরু হয় পরিবার  থেকে। তারপর পাড়ায়-মহল্লায়, স্কুল-কলেজ ও মসজিদ-মাদ্রাসা তাকে নির্মাণ করে। শুদ্ধ সংস্কৃতি নির্মাণে এগুলোই অপরিহার্য পাঠশালা । এখান থেকেই নতুন প্রজন্ম ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পূণ্য বুঝতে শেখে। উন্নত চরিত্র গঠনের পাঠ নেয়। জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কি তা শেখানো হয়। আল্লাহ ও রাসূলকে চেনানো হয়। শেখানো হয় বড়দের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহ করতে। মানুষের সঙ্গে ব্যবহার শিষ্টাচারও তারা এখানে শেখে। এভাবে চরিত্র গঠনের সকল পাঠই তারা পায় এখান থেকে। এভাবে নতুন প্রজন্মরা প্রতিদিনই ইসলামী সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে ইসলামী সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক।

এখন কি হচ্ছে? সব ক্ষেত্রেই অপসংস্কৃতি ভিতর থেকে পথ রোধ করে দিচ্ছে। পারিবারে হয়তো বাবা-মা সন্তানকে যথাযথ জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করেন; কিন্তু পাড়া-মহল্লা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের বদলে দেয়। পাড়া মহল্লায় উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের নষ্ট পরিবেশে মিশে ভুলে যায় পরিবারের শিক্ষা। তারা কেউ হয়ে ওঠে নেশাখোর, কেউ চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী, কেউ ইভটিজার-ধর্ষক,কেউবা নেতার লেঠেল।

আরও পড়ুন-

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেনো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো?

শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা 

শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য চলছে গভীর ষড়যন্ত্র। এতে ত্বরান্বিত হচ্ছে ইসলামী সংস্কৃতির পরাজয়।

কয়েকটি উদাহরণ

আফ্রিকার সবচেয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইউনির্ভাসিটি অব সাউথ আফ্রিকা’। এর প্রবেশদ্বারে লেখা রয়েছে –  “কোন জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক হামলা কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের দরকার নেই। বরং সেই জাতির শিক্ষার্থীদের পরিক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে। কারণ এভাবে পরিক্ষা দিয়ে তৈরি হওয়া ডাক্তারদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে। ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা নির্মিত দালান-কোঠা, ইমারত ধ্বংস হবে এবং অর্থনীতিবিদের দ্বারা দেশের আর্থিক খাত দেউলিয়া হবে। এ ছাড়া বিচারকদের হাতে বিচারব্যবস্থার কবর রচনা হবে। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মানে হলো একটি জাতির অবলুপ্তি।”

মুসলিম ইতিহাসের অন্যতম সেনাপতি আল কুদস বিজেতা সুলতান সালাউদ্দিন আইবি বলেছেন,

“যুদ্ধ ছাড়া কোনো জাতিকে ধ্বংস করে দিতে চাও, তবে ঐ জাতির তরুণদের মাঝে অশ্লীলতা বেহায়াপনা ছড়িয়ে দাও”।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম শ্রেণী প্রথম হওয়া জনৈক শিক্ষার্থীর কথা, ‘একটা জাতিকে ধ্বংস করার জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন নেই। আপনি সেই জাতির যুব সমাজকে মাদকে আসক্ত এবং শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিলেই হবে। দুর্ভাগ্য জনক হলেও আমরা সেদিকেই যাচ্ছি”।

দেশের এক খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ বলেছেন,একটি জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য সে জাতির শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়াই যথেষ্ট। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও চলছে ইসলামী সংস্কৃতি ধ্বংসের নানা লীলাখেলা। পাঠ্য বই থেকে ইসলামের ইতিহাস উঠিয়ে দিয়ে সেখানে শেখানো হচ্ছে পৌরাণিক কাহিনী, ধর্ম শিক্ষার বদলে অপ্রাপ্ত বয়সে দেয়া হচ্ছে যৌন শিক্ষা। পড়াশোনা , পরীক্ষার গুরুত্ব কমিয়ে দিয়ে ছেলেদেরকে শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। ইসলামী সংস্কৃতি নষ্ট করার জন্য অপসংস্কৃতির রয়েছে নানাবিধ কর্মকৌশল। সে সব বিষয়েও আমাদের জানতে হবে। যথেষ্ট সতর্কও থাকতে হবে।

শেষ কথা 

ইসলামী সংস্কৃতির জয় মানে ইসলামের বিজয়। আইয়ামে জাহেলিয়াতের কথা আমরা জানি। নবিজির জন্মের সময়ে গোটা আরব ছিল অন্ধকারে নিমজ্জিত। হেন পাপ কাজ নেই যে তারা করত না। সেই সমাজে নবিজি এনেছিলেন ইসলামের শান্তির ফল্গুধারা। দূর হয়েছিল সকল অনাচার, পাপাচার। এ পথই কেবল পথ। এ পথের সংস্কৃতিই সঠিক সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতির বিজয় আনতে হলে অবশ্যই নবীজির পথকে অনুসরণ করতে হবে। কেবল তখনই আসবে ইসলামী সংস্কৃতি বিজয়।

লেখকঃ  কবি , সাহিত্যিক এবং  সাবেক এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে  লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ  লেখা, গল্প, কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক!  আপনি আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ;  মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই ।  আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

ফেসবুকে লেখক শহীদ সিরাজী

আরও পড়ুন