Ads

ইসলামী সংস্কৃতির ভিতর বাহির

।। আসাদ বিন হাফিজ ।।

সংস্কৃতি বলতে কেবল গান বুঝায় না, শিল্পের সব মাধ্যমকেই সংস্কৃতি ধারণ করে। সংস্কৃতির বিকাশ বলতে সব মাধ্যমের বিকাশকেই বুঝায়। এর মধ্যে অবস্থান নেয় নন্দনতত্ত্বের সকল শাখা। এর মধ্যে সাহিত্য আছে, এবং প্রবলভাবেই আছে। আরো আছে শিল্পকলা, চারুকলা, নাটক, সিনেমা সব।

যারা ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশ চান শিল্পের সব মাধ্যমকে এগিয়ে নেয়াই তাদের দায়িত্ব। আলহামদুলিল্লাহ, এর অনেক শাখাতেই ইসলামী সংস্কৃতি কাজ করছে। যেসব অঙ্গনে তারা এখনো হাত দেয়নি সে সব অঙ্গনে হাত দেয়ার সামর্থ্য ও উপযুক্ত জনবল এখনো তৈরী হয়নি এবং এ মুহূর্তে তা খুব জরুরীও নয় বলে আমি মনে করি।

আমার মনে করার বিষয় নয়, সবার সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতেই ইসলামী সংস্কৃতি অগ্রসর হবে। আশা করি, যারা ইসলামী সংস্কৃতি নিয়ে ভাবেন, তারাও তাদের সুচিন্তিত মতামত পেশ করবেন। এ ক্ষেত্রে পাইওনিয়ারের ভূমিকা পালন করেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। তিনি নিজে গান লিখতেন, সুর দিতেন ও গাইতেন। তিনি কবিতা রচনা করতেন, প্রবন্ধ রচনা করতেন। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় ঘুরে বেড়াতেন। তিনিই সংস্কৃতিতে ইসলামী ধারা প্রবর্তনের উদ্যোগ নেন। শুরুতে তিনি ছিলেন একক। তিনি এর কলেবর বৃদ্ধি করতে চাইলেন। নতুন শিল্পী ও সাহিত্যিক জোগাড় হলো। আস্তে আস্তে এ ধারা ব্যাপকতা লাভ করলো।

সে সময় বিপরীত উচ্চারণে যারা লেখা পড়তেন এবং সাইমুমে গান গাইতেন তারা কি সবাই শেষ পর্যন্ত এ ময়দানে টিকে থাকতে পেরেছেন? না। তবে সেখান থেকেই বেরিয়ে এসেছে একদল শিল্পী ও সাহিত্যিক। তারাই এখনো পর্যন্ত সক্রিয় থেকে এ ধারাকে বেগবান করেছেন। নতুনের আগমন ঘটেছে এবং আরো ঘটবে, আর এভাবেই এ ধারা এগিয়ে যাবে। এ জন্য আমাদের চিন্তা করতে হবে কিভাবে এ ধারাকে সমৃদ্ধ করা যায় এবং সেভাবেই এগুতে হবে। আবেগ নয়, নির্মোহ চিন্তা করতে হবে কি করে এ দেশকে একটি সুস্থ সংস্কৃতি উপহার দেয়া যায়।

আরও পড়ুন- সাহিত্য চর্চার উদ্দেশ্য কি

আমি মনে করি, ইসলামী সংস্কৃতি তার প্রথম ধাপ অতিক্রম করেছে, এখন একে বিকশিত করার কার্যকরী উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। নন্দনতত্ত্বের যে কোন মাধ্যমই কোয়ান্টিটির চাইতে কোয়ালিটির দাম দেয়। ইসলামী সংস্কৃতির কাজ করার জন্য যে পরিমাণ কোয়ান্টিটি দরকার তা আমরা করতে পেরেছি, সময়ের সাথে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আরো প্রতিভা এসে এ অঙ্গনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমাদের এখন দরকার কোয়ালিটির। আব্বাসউদ্দিন, ফিরোজা বেগম হাজার হাজার হয় না, কিন্তু তারা একজন নজরুলকে নজরুল বানাতে পেরেছেন। কথা সাহিত্যে জামেদ আলী যে ধারা নির্মাণ করেছেন, আজকের সময়ে সেই কোয়ালিটি নিয়ে কেউ দাঁড়াতে পারেনি। প্রবন্ধ বা গদ্যে আবদুল মান্নান তালিবের কোয়ালিটি এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এর অন্যতম কারণ, কোয়ালিটি নির্মাণে আমরা সচেষ্ট ছিলাম না। আমরা ছিলাম কোয়ান্টিটি বৃদ্ধিতে সক্রিয়।

এখনো মাসিক রিপোর্টে কতজন শিল্পী বৃদ্ধি পেলো, কতজন গীতিকার বৃদ্ধি পেলো, কতজন সুরকার বৃদ্ধি পেলো, কতজন লেখক বৃদ্ধি পেলো সে রিপোর্ট শাখাগুলোকে দিতে হয়। ফলে সংগঠকদের মধ্যে তৈরী হয় সংখ্যা বৃদ্ধির মানসিকতা এবং এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার মানসিকতা পরিহার করা দরকার। স্বাভাবিকভাবে যে প্রতিভা আসবে তা লালনই যথেষ্ট। প্রতিযোগিতায় সংখ্যা বাড়বে কিন্তু আমাদের দরকার এখন একজন মল্লিক বা একজন মোশাররফ হোসেন খান।

সংগঠন প্রতিভা জন্ম দিতে পারে না, বিকাশ ঘটাতে পারে। ভ্রমণ কাহিনী লেখার জন্য বুলবুল সরওয়ার একজনই হয়। শিল্পের জন্য হামিদুল ইসলাম বা মুমিনউদ্দীন খালেদ নিজেরাই তৈরী হয়েছে। তাদের শিল্পীসত্ত্বা সংগঠন বানিয়ে দেয়নি, সংগঠন তাদের বিকাশে সহায়তা করেছে মাত্র। সংগঠনের কাজ প্রতিভা জন্ম দেয়া নয়, তাদের বিকাশে সহায়তা করা। এই বিকাশ পরিকল্পনাটাই এখন মুখ্য বিষয়। কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রত্যেক জেলা, থানা এ উদ্যোগ নিতে পারে। প্রতিভা ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট বিষয়।

এখন অনেক হাউজ হয়েছে, গানের বিকাশে তারাই ভূমিকা রাখছে। ব্যক্তিরা উঠে আসছে সেসব হাউজের মাধ্যমে। তাদের বিকাশেও সংগঠনের চাইতে হাউজগুলো এখন অনেক বেশী ভূমিকা রাখছে। এ ক্ষেত্রে সংগঠন সীমিত ভূমিকা রাখলেই চলবে। দরকার হাউজগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। গান সংশ্লিষ্ট লোকদের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন ও সুপারভিশন।

এবার সাহিত্যক্ষেত্রে আসি। ইসলামী ধারার সাহিত্য রচনা শুরু হয় আশির দশকে। এখানেও মল্লিক ছিল সেনাপতি। তিনি মরার পর চৌদ্দ বছর অতিবাহিত হচ্ছে। তার রচনাবলী প্রকাশ না হওয়ায় ইসলামী সাহিত্য কেমন সে চেহারাই এখনো জনগণ দেখতে পারেনি। অতিশীঘ্রই তা প্রকাশ হওয়া দরকার। অল্প কয়েকজনকে নিয়ে তিনি আশির কাব্যান্দোলন শুরু করেছিলেন। তারা মল্লিকের সমসাময়িক এবং একই ধারার লেখক। তাদের রচনাবলী না হলেও কাব্যসমগ্র কেন্দ্রের উদ্যোগ ও তত্ত্বাবধানে বের হলেও লেখকরা জানতে পারতো ইসলামী ধারার সাহিত্য কেমন হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে কেন্দ্র পুরোপুরি নির্বিকার। কেন্দ্র তাদের বই প্রকাশ তো দূরে, কেউ কেউ অভিযোগ করেছে, নিজ উদ্যোগে সমগ্র করার পরও কেন্দ্র কোন বই ক্রয় পর্যন্ত করেনি। এটা দুঃখজনক।

যে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য তারা প্রাণপাত করলো এবং বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারা প্রবর্তন করলো সেই ইসলামী সাহিত্য, কেন্দ্রের কোন পৃষ্ঠপোষকতাই পেলো না। যাদেরকে এ আন্দোলনে শরীক করেছিল মল্লিক, তারা হয়ে পড়লো না ঘরকা না ঘাটকার মধ্যে। তাদের ছিটেফোটা কাব্য যদি (পত্রিকায় প্রকাশিত) বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে, তবে কাব্যসমগ্র হাতে পেলে এটাই হতে পারতো বাংলা সাহিত্যের মূল ধারা, মানে ইসলামী সাহিত্যই বাংলা সাহিত্যের মূল ধারা। যাক, এটা হয়নি। নিদেন পক্ষে আশির কাব্য বিপ্লব নিয়ে যদি ‘আশির ইসলামী কবিতার সংকলন’ বের হতো, কর্মীরা উজ্জীবিত হতো, নতুন লেখকরা দিক নির্দেশনা পেতো। এরকম কেন কিছুই হয়নি, যা আশির কবিদের মর্মাহত করেছে।

নতুন লেখক খুঁজে বের করা একটি মহৎ উদ্যোগ। এ জন্য পান্ডুলিপি প্রতিযোগিতা নতুন লেখকদের মধ্যে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। কিন্তু তারা পড়েছে বিপাকে। তাদের সামনে ইসলামী কাব্য বা গল্প উপন্যাস না থাকায় প্রচলিত ধারায় লেখেছে। সে সব পান্ডুলিপি অবৈধ প্রেমের কাহিনীতে ভরপুর। কবিতায় যৌন উত্তেজক ও শিরিকি শব্দ থাকায় সে প্রতিযোগিতা তেমন কোন সাফল্য বয়ে আনেনি বরং উল্টো ইমেজ তৈরী করেছে। এসব নতুন লেখকরা ভেবেছে, এটাই লেখার মানদন্ড। প্রেম কাহিনী লিখে পুরস্কার তো পেলামই, উপরন্তু কেন্দ্রের ফিনান্সে বইও বের করতে পারলাম। ফলে, নতুন করে তারা আরো প্রেম কাহিনী লেখায় মত্ত হয়ে পড়লো।

তারা আবদুল মান্নান তালিবের “ইসলামী সাহিত্য: মূল্যবোধ ও উপাদান” হয়তো অনেকেই পড়েনি, ফলে তারা কোন দিকনির্দেশনাও পায়নি। ইসলামী সংস্কৃতি করতে গেলে এ বইটি পড়া ফরজ। বর্তমানে আমাদের ইসলামী সাহিত্য আন্দোলন মাঝি ছাড়া নৌকার মত দুলছে। পত্রপত্রিকার সাহিত্য পাতাগুলোও চলছে স্বাধীনভাবে।

ইব্রাহীম মন্ডল, আরিফুর রহমান, আমিনুল ইসলাম, আবদুর রহীম এরা ইসলামী ক্যালিগ্রাফিকে একটা নান্দনিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ঠাঁই করে নিয়েছে আমাদের ক্যালিগ্রাফি। বিদেশের প্রদর্শনীতেও ঠাঁই পাচ্ছেন তারা। মন্ডলের অবিরাম লেগে থাকায় এ অর্জন আমরা পেয়েছি। কাজ চলছে চতুর্দিকে। মঞ্চস্থ হচ্ছে নাটকও।

আমরা কাজ করছি ঠিক, কিন্তু প্রায়োরিটি নির্ধারণে ইসলামের চাইতে পুঁজিবাদ আমাদের আকর্ষণ করছে বেশী। এটি হতে পারে আগামী দিনে ইসলামী চেতনার হন্তারক তৎপরতা। খুলুসিয়াত ছাড়া চালাকি করে ইসলাম হয় না। ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশ চাইলে এ পুঁজিবাদী মানসিকতা পরিহার করতে হবে। মানসিকতা পরিশুদ্ধ করতে হবে। স্বার্থপরতা পরিত্যাগ করতে হবে। ভালবাসার বিস্তার ঘটাতে হবে। এমন পরিকল্পনা নিতে হবে যাতে কারো মধ্যে অহংবোধ জন্ম না নেয়।

কলাগাছে বটগাছ বলা বন্ধ করতে হবে। অহেতুক নামের আগে পিছে একগাদা টাইটেল দিয়ে কারো নাম ঢেকে ফেলার প্রবণতা ছাড়তে হবে। যারা প্রকৃত গুণী তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। ব্যক্তি নয়, সৃষ্টি হোক আমাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। প্রকৃত ইসলাম প্রতিষ্ঠা হোক আমাদের স্বপ্ন ও ধ্যান ধারণা। কোরআন হোক আমাদের চালিকাশক্তি।

লেখকঃ কবি, সাহিত্যিক এবং শিক্ষক, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজ

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা,গল্প,কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক!  আপনি আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন,“তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) ।আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

ফেসবুকে লেখক আসাদ বিন হাফিজ

আরও পড়ুন