Ads

জিন্নাহ নয়, পাকিস্তানের স্রষ্টা নেহরু ও প্যাটেল

।। আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ।।

জসওয়ান্ত সিং এর গ্রন্থ ব্যবচ্ছেদ

১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগকে মহাত্মা গান্ধীর মতো অনেকে বলেছেন ‘জীবন্ত প্রাণীকে কেটে খণ্ড খণ্ড’ করার মতো, এ ঘটনা নিঃসন্দেহে উপমহাদেশে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড়ো আঘাত ছিল। এই বিভাজন উপমহাদেশের চারটি প্রজন্মের জনগোষ্ঠীর মন-মানসিকতাকে প্রভাবিত করেছে। এই বিভাজন কেন ঘটেছিল? এজন্য কে দায়ী ছিল — জিন্নাহ? না কি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস? অথবা ব্রিটিশ রাজশক্তি? ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সাবেক পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জসওয়ান্ত সিং ২০০৯ সালে প্রকাশিত তাঁর “জিন্নাহ: ইন্ডিয়া-পার্টিশন ইন্ডিপেন্ডেন্স” গ্রন্থে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন। তিনি তার গ্রন্থে দেখাতে চেয়েছেন যে, জিন্নাহর রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত’ হিসেবে, যে উপাধি তাঁকে দিয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা গোপাল কৃষ্ণ গোখলে। তার এ অভিযাত্রা শেষ হয়েছিল ভারতীয় মুসলমানদের ‘একমাত্র মুখপাত্র’ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার মধ্য দিয়ে। কীভাবে ও কেন তাঁর রূপান্তর ঘটেছিল পাকিস্তানের স্রষ্টা, কায়েদ-ই-আজম হিসেবে?

কোনো ভারতীয় বা পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ ও পার্লামেন্ট সদস্য কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র একটি বিশ্লেষণধর্মী রাজনৈতিক জীবনী তুলে ধরেননি। তাঁর জীবন ও কর্মের ওপর যেসব গ্রন্থ রয়েছে, সেগুলো অধিকাংশই একদেশদর্শী ও প্রচারধর্মী অথবা তাকে ভারত বিভাগের জন্য দায়ী করে তাঁকে খলনায়ক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সেদিক থেকে জসওয়ান্ত সিং এর গ্রন্থটিকে বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন: “ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম কোথায় এবং কখন একটি পৃথক জাতি হিসেবে মুসলমানদের উদ্ভব ঘটেছিল? এবং এটি পাকিস্তানকে কোথায় টেনে নিয়ে গেল? মুসলিম জাতিসত্তাই যদি মুখ্য হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলো কেন? এছাড়া এখন পাকিস্তানের অবস্থাই বা কি? কোন দিকে যাচ্ছে পাকিস্তান? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার ক্ষেত্রে জসওয়ান্ত সিং এর গ্রন্থটি অনন্য। কারণ লেখক স্বয়ং নীতি-বিশেষজ্ঞ, যিনি সুনির্দিষ্ট উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য নীতির উদ্ভাবক। ১৯৪৭ সালের পর থেকে দেশবিভাগের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে উপমহাদেশ এবং মাঝে মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ-সংঘাত সেই পুরোনো ক্ষতকে নিরাময়ের অযোগ্য করে তুলছে। তিনি তাঁর গ্রন্থের শেষদিকে নিজেই বড়ো একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে যে, “শেষ পর্যন্ত দেশ বিভাগে কি অর্জিত হয়েছে?

জসওয়ান্ত সিং এর গ্রন্থ ব্যবচ্ছেদ

জসওয়ান্ত সিং বিশ্বাস করতেন যে, “দক্ষিণ এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য প্রথমেই আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, আমরা পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার যে উপাদানগুলো পরিত্যাগ করেছি, সেগুলো ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো, আমরা কখনও শান্তি ফিরিয়ে আনতে কাউকে সম্মত করাতে পারবো না।” তিনি তাঁর গ্রন্থেও শুরুতেই স্বীকার করেছেন যে, তিনি জিন্নাহর রাজনৈতিক জীবনী লিখছেন, ভারতের একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক জীবনী, যা তিনি আগে কখনও করেননি। তিনি বিনয়ের সঙ্গে একথাও স্বীকার করেছেন যে তিনি কোনো পেশাদার ইতিহাসবিদ নন। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর বইটি সবসময় আগ্রহের বিষয় হিসেবে থাকবে।

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিজেপি নেতা জসওয়ান্ত সিং তাঁর কূটনীতি ও রাজনীতির চেয়ে ইতিহাস রচনার জন্য অধিক পরিচিত। যদিও তিনি নিজেকে ইতিহাসবিদ বলে দাবি করেননি, কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম আলোচিত ও বিতর্কিত একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জীবনীকে কেন্দ্র করে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি পর্যায়ের ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন এবং একজন পাণ্ডিত্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। উপমহাদেশের বিভক্তি ও স্বাধীনতার ওপর তাঁর তথ্যবহুল গ্রন্থ “জিন্নাহ, ইন্ডিয়া-পার্টিশন ইন্ডিপেন্ডেন্স” এ বিশদ বিবরণ, ব্যাখ্যা ও বিস্তৃতিকরণ, ভাষার শৈলী এবং ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ এমনকি দক্ষ ইতিহাসবিদের জন্যও অনুকরণযোগ্য। কারণ যে প্রশ্নগুলোর উত্তর সহজে পাওয়া যায় না, সেগুলো তিনি তুলে এনেছেন অভিজ্ঞ ডুবুরির মতো। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে তাঁর গবেষণা তাঁকে উপসংহারে উপনীত হতে সহায়তা করেছে যে,

প্রচলিত ইতিহাস ভারত বিভাগের জন্য মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে দায়ী করে তাঁকে খলনায়কের ভূমিকায় দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, ভারত বিভাগের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং সরদার বল্লভভাই প্যাটেল।

ভারতীয় উপমহাদেশকে দুটি দেশ মুসলিম পাকিস্তান ও হিন্দু ভারতে বিভক্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা যদি নিষ্ঠাবান হতেন, তাহলে এ বিভাজন এড়ানো সম্ভব হতে পারতো। কিন্তু তারা তা এড়াতে পারেননি। ফলে উপমহাদেশ চিরস্থায়ীভাবে বহু বিষয়কে অমীমাংসিত অবস্থায় রেখেছে, যা এখনও এই বিশাল অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে তাড়িত করে। ভারত ভাগের সঙ্গে জড়িত পরিসংখ্যান ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার নয়। কারণ এই রাজনৈতিক বিপর্যয়ে প্রাণ হারিয়েছিল আনুমানিক ১৩ লাখ মানুষ; উদ্বাস্তু হয়েছিল দেড় কোটি লোক; শরণার্থী হয়ে ভারতে এসেছিল ১৫ লাখ হিন্দু ও শিখ এবং এবং পাকিস্তানে গিয়েছিল ৯০ লাখ মুসলিম। দেশ বিভাগ বাস্তবায়িত হওয়ার পর থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত আনুমানিক ৪ হাজার মুসলিম ট্রেনযোগে প্রতিদিন উত্তরপ্রদেশ থেকে পাকিস্তানে গেছে। এছাড়া এ বিপর্যয় চলাকালে ১০ লাখনারী ধর্ষিত হয়েছিল।

জসওয়ান্ত সিং এর গ্রন্থে প্রধান গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যে: জিন্নাহকে অকারণে ভারত বিভাগের জন্য দায়ী করে তাঁকে দানব রূপ দেওয়া হয়েছে। অথচ তিনি এক মহান ব্যক্তি ছিলেন এবং ভারত বিভাগের জন্য সম্পূর্ণ দায়ী ছিলেন না। পন্ডিত নেহরু প্রধানত দেশভাগের জন্য দায়ী ছিলেন; কারণ তিনি একটি কেন্দ্রীভূত ভারতে বিশ্বাস করতেন, যা হিন্দু আধিপত্য থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য মুসলমানদের জন্য কোনো সুযোগ রাখেনি। মহাত্মা গান্ধী এবং অন্যান্য কংগ্রেস নেতা, যারা দেশভাগের বিরোধিতা করতেন, তারা দেশভাগের পক্ষে নেহরু’র মুখ্য ভুমিকার বিরুদ্ধে জোরালো কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেননি।

আরও পড়ুন-মুসলমানের রক্তে লেখা ভারতের স্বাধীনতা

জসওয়ান্ত সিং তার গ্রন্থে কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছেন, যা পাকিস্তান সৃষ্টির প্রক্রিয়ার সূচনা ও পরবর্তী সমাপ্তি চিহ্নিত করে। সেগুলো হলো- ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, ১৯৩৩ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী কর্তৃক ‘পাকিস্তান’ নাম তৈরি এবং ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ অধিবেশনে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘লাহোর প্রস্তাব’ পাস। তিনি আরও বলেছেন, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলেও তারা তখনই পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়নি। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার প্রতিক্রিয়া হিসেবে উগ্র হিন্দুরা ১৯১০ সালে হিন্দু মহাসভা গঠন করে। হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাকারীদের অনেকে ছিলেন কংগ্রেস নেতা। লন্ডনে প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে পর কংগ্রেসের প্রতি জিন্নাহর মোহভঙ্গ ঘটে। ইতোমধ্যে হিন্দু মহাসভা সামগ্রিকভাবে এবং কংগ্রেস নেতাদের একটি অংশ ভারতে হিন্দু-মুসলিম সমস্যার বাস্তব সমাধান হিসেবে লালা লাজপত রায়, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ও সরদার বল্লভভাই প্যাটেলের ভারত বিভাগ প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল। সবই ছিল মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার প্রতিশোধ নেয়ার উদ্দেশ্যে। মহাত্মা গান্ধী ভারত বিভাগ এড়াতে জিন্নাহকে অখন্ড ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদে বসানোর প্রস্তাব করলেও উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তিনি তা গ্রহণে তাঁর অনাগ্রহ প্রকাশ করেন।

জসওয়ান্তের গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর ভারত জুড়ে হৈ চৈ শুরু হয়েছিল। রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ছিল ভয়াবহ, বিশেষ করে তিনি নিজের দল, উগ্র হিন্দু দল বিজেপি’র মূল বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হয়েছেন অভিযোগে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। শুধু বিজেপি নয়, কংগ্রেসসহ অন্যান্য দলকেও অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়, কারণ জসওয়ান্ত সিং ভারতের দুই স্বর্গীয় নেতা জওহরলাল নেহরু ও সরদার প্যাটেলকে দেশ বিভাগের প্রকতৃ খলনায়ক ও দায়ী ব্যক্তিতে পরিণত করেছেন। ভারতের শিক্ষাবিদরা দালীলিক প্রমাণ সমৃদ্ধ এমন গ্রন্থ গ্রহণ করার পাশাপাশি এটিকে প্ররোচনামূলক বলে প্রত্যাখ্যান করলেও সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকদের সিংহভাগ গ্রন্থটিকে গবেষণার চমৎকার এক ফসল এবং ইতিহাসের ছিন্ন সূত্র ধরিয়ে দেওয়ার সাহসী প্রচেষ্টা হিসেবে বর্ণনা করেছে লেখকের প্রশংসা করেছেন যে দীর্ঘ সময় পর হলেও তিনি একটি গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন।

ভারতের সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী অত্যন্ত ধৈর্য্যরে সঙ্গে বহু তথ্য উদ্ধৃত করে প্রমাণ করেছেন যে, নেহরু এবং প্যাটেল যদি দেশবিভাগের পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ না করতেন, তাহলে ‘পাকিস্তান’ নামে কোনো রাষ্ট্রের জন্ম হতো না। তাঁর গ্রন্থ ২০০৯ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে উপমহাদেশের দেশগুলোর রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে তীব্র প্রতিক্রয়ার সুষ্টি হয়েছে। তিনি এই সত্য উচ্চারণ করে ভারতীয়দের ক্ষোভের কারণ হয়েছেন যে, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ হিন্দু-মুসলিম ঐক্য বজায় রাখার লক্ষ্যে কাজ করতে আগ্রহী এক মহান ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের মুসলিম বিদ্বেষী আচরণ জিন্নাহ’র নামকে মুসলমানদের আশা-আকাংখর সমার্থক করে তোলে।

কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে মুসলমানদের পৃথক জাতি হিসেবে স্বীকার না করে সবসময় এমন ভাব প্রকাশ করেছে যে, ভারত স্বাধীন হলে মুসলমানরা এমনিতেই উপকৃত হবে। অর্থ্যাৎ কংগ্রেসের দৃষ্টিতে ভারতের স্বাধীনতায় মুসলমানদের যতটা উপকার হবে, তা কংগ্রেসের প্রাপ্ত সুবিধার বাই-প্রেডাক্ট। মুসলমানদের প্রতি কংগ্রেসের এই উদাসীনতা জিন্নাহকে অখন্ড ভারতে মুসলমানদের মধ্যে পৃথক একটি জাতি গঠনের স্বপ্ন জাগ্রত করার আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। জসওয়ান্ত সিং এর গ্রন্থ এ সত্যও তুলে ধরেছে যে, মুসলিম প্রশ্নে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার মধ্যে আদর্শগত তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। এমনকি তিনি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলার প্রচেষ্টার কথাও খুব কম উল্লেখ করেছেন।

জসওয়ান্ত সিং তার গ্রন্থে এটাও স্বীকার করেছেন যে, স্বাধীনতার পর নেহরু দেশভাগের জন্য অনুশোচনা করেছেন এবং আশা করেছেন যে, ঘটনাটিকে আবারও ঘুরিয়ে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু কখনও এটা জানার জন্য উদ্যোগী হননি যে, নতুন পরিস্থিতিতে জিন্নাহকে কি ভাবতে হয়েছিল।

ইংলিশ ইতিহাসবিদ, নাট্যকার ও লেখক অ্যালেক্স ফন টানজেলম্যান তার বিখ্যাত গ্রন্থ “ইন্ডিয়ান সামার: দ্য সিক্রেট হিস্টরি অফ দ্য এন্ড অফ অ্যান এম্পায়ার” এ লিখেছেন, “জিন্নাহ’র ডাক্তারের মতে, তাঁর শেষ সময়ে লিয়াকত আলি খান তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি তাঁকে বলেন যে, ‘আমার জীবনে পাকিস্তান ছিল সবচেয়ে বড়ো ভুল। এখন যদি সুযোগ পাই, তাহলে আমি দিল্লি যাব এবং জওহরলালকে বলবো অতীতের ভুলত্রুটি ভুলে গিয়ে আবার বন্ধু হতে।”

এই বক্তব্যের মধ্যে তাঁর আগের এক মন্তব্যের ছাপ পরিস্ফুট ছিল, যখন পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর পর পাকিস্তান টাইমস পাঞ্জাবের উদ্বাস্তু সংকটের ওপর এক বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ করে। তিনি সেটি পাঠ করে দুই হাতে মাথা ধরে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘হায় আমার আল্লাহ, এটা আমি কি করেছি?’ টানজেলম্যান আরেকটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন যে, মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবি যখন তুঙ্গে তখন চার্চিলও ভারত বিভাগের পক্ষে সায় দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-

জসওয়ান্ত সিং তাঁর গ্রন্থের সূচনাতে ভারত বিভাজনের জন্য নেহরু ও সরদার প্যাটেলকে দায়ী করেছেন গ্রন্থটি পড়তে সামনের পৃষ্ঠাগুলোতে এগিয়ে যেতেই দেখা যায় যখন তিনি বলেন যে কংগ্রেসের দুই শীর্ষ নেতা ‘সার্জিক্যাল অপারেশন’ চালিয়ে ভারত ভাগ করেছেন। মাউন্টব্যাটেনও প্রথমে বলেছিলেন যে, দুঃখজনকভাবে নেহরু এবং প্যাটেল ও কংগ্রেস পার্টি এই দেশ ভাগে সম্মতি দিয়েছিল। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে কোনও ভাবে এ ধরনের একটি বিকল্প উপায় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মি. সিং তাঁর গ্রন্থে আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানি ও শিক্ষাবিদ লয়েড আরভিং রুডলফ এবং তাঁর স্ত্রী সুজান রুডলফ এর এক লেকচারের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যেখানে তারা বলেছেন যে, “জিন্নাহ উদারনৈতিক, সারগর্ভশীল এবং একজন আপাদমস্তক ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন, যিনি ভারতের অখণ্ডতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন।” এমনকি ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো তাঁকে “কংগ্রেসের চেয়ে বেশি কংগ্রেসী” বিবেচনা করতেন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও মুসলিম লীগ এবং আরও কিছু মুসলিম সংগঠনকে ভারত ভেঙে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন বলে যে দোষারূপ করা হয়, তা যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ছিল এ ধরনের উদ্ধৃতিই এটা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। কংগ্রেস এবং দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা মোহনদাস গান্ধী, গোপাল কৃষ্ণ গোখলে এবং বাল গঙ্গাধর তিলক হিন্দু-মুসলিম সদ্ভাব-সম্প্রীতি বজায় রেখে অখণ্ড শক্তিশালী ভারত গঠনের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। যদিও বাল গঙ্গাধর তিলক হিন্দু ও মুসলমানদের পৃথক জাতিসত্তার কথা বলেছেন।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং ভারতের জন্য জিন্নাহ’র অবদান ছিল অনুকরণীয়। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে ধ্যান-ধারণা ও উপলব্ধির পরিবর্তন ঘটে। মি. সিং এর রচনায় অখণ্ড ভারতের প্রতি জিন্নাহ’র প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটেছে এবং তিনি লিখেছেন: ‘কংগ্রেস মহলেও জিন্নাহ’র অবস্থান ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।’ রাজনীতির জটিল আলোচনা সূক্ষ্মভাবে পরিচালনার মাধ্যমে এবং কংগ্রেসে বাল গঙ্গাধর তিলকের অমূল্য সমর্থনে উভয় পক্ষের যৌথ পরিকল্পনার সংস্কার করা হয়েছিল। এটি ‘কংগ্রেস-লীগ জয়েন্ট স্কিম অফ রিফর্মস’ অথবা জনপ্রিয়ভাবে ‘লখনউ চুক্তি’ হিসেবে খ্যাত হয়েছিল। এই চুক্তিতে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়েছিল ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের’ জন্য আন্তরিকতা ও পরিশ্রমের কারণে, যা ১৯১৬ সালের ১ জানুয়ারি সংখ্যা বোম্বে ক্রনিকল এ বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছিল। ওই সময়েই জিন্নাহ ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

জসওয়ান্ত সিং তাঁর গ্রন্থে জিন্নাহকে ভারতের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য উপযুক্ত মানুষ হিসেবে তুলে ধরেছেন এবং ভারতকে অখণ্ড রাখার জন্য জিন্নাহ’র মহৎ উদ্দেশ্যের পক্ষে বিভিন্ন সূত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন,

“লন্ডনে গোলটেবিল সম্মেলনে জিন্নাহ’র অবস্থান ছিল অনন্য। গোলটেবিল সম্মেলনে তাঁর ভূমিকার কারণে হিন্দুরা তাঁকে একজন মুসলিম সাম্প্রদায়িক হিসেবে বিবেচনা করে, মুসলমানরা তাঁকে মনে করে ‘হিন্দুপন্থী; দেশীয় রাজন্যরা তাঁকে ‘অতি গণতান্ত্রিক’ বলে ধরে নেয়। অন্যদিকে বৃটিশরা তাঁকে মনে করে একজন চরমপন্থী। তিনি সর্বত্র বিরাজমান, আবার তিনি যেন কোথাও ছিলেন না। কেউই তাকে চায়নি।”

তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, ‘সেপ্টেম্বও মাসের শেষ দিকে জিন্নাহ যখন তাঁর চৌদ্দ দফা দাবি পুরোপুরি গ্রহণ করার কথা বার বার বলতে থাকেন, তখন জওহরলাল নেহরু এই বলে বিদ্রুপ করেন যে, “আমার অবাক লাগছে যে, চৌদ্দ দফা মেনে নেয়া হবে তা আমার জন্য অধিক ভয়াবহ হবে। আমাকে যদি আমার প্রিয় বন্ধু মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র কথা শুনতে হয় এবং কোনো সময়ে চৌদ্দ দফার কোনো একটি অংশ মেনে নিতে বলা হয়, তাহলে আমি দক্ষিণ সাগরের কোনো দ্বীপে গিয়ে অবসর যাপনের কথা বিবেচনা করবো, যেখানে চৌদ্দ দফা নিয়ে কথা বলার জন্য যথেষ্ট বুদ্ধিমান বা যথেষ্ট অজ্ঞ লোকের সঙ্গে দেখা হবে, এমন আশা করবো।”

১৯২৯ সালের মার্চ মাসে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের দিল্লি অধিবেশনে জিন্নাহ’র উত্থাপিত চৌদ্দ দফা ছিল ভারতের ভবিষ্যৎ সাংবিধানিক সংস্কার পরিকল্পনার প্রস্তাব। প্রস্তাবগুলোতে স্বাধীন ভারতে মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার দাবি ছিল, ভারতকে ভাগ করার কোনো ইঙ্গিতও ছিল না প্রস্তাবে। প্রস্তাবের মুখ্য দফাগুলো ছিল ভারতে ফেডারেল পদ্ধতির শাসন, যেখানে প্রাদেশিক বিষয়, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে অর্পণ; সকল প্রদেশের একই ধরনের স্বায়ত্তশাসন ও প্রাদেশিক সংহতি সুনিশ্চিত করা; সকল প্রাদেশিক আইনসভা ও অন্যান্য নির্বাচিত প্রতিনিধি সভা নির্দিষ্ট নিয়মে নির্বাচন ও মনোনয়ন; প্রতিটি প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব না কমিয়ে সংখ্যালঘুদের কার্যকর জনপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা অথবা সমপ্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা; সম্প্রদায়গত, গোষ্ঠীগত বা গোত্র ভিত্তিক জনপ্রতিনিধিত্বের বর্তমান ব্যবস্থার অনুরূপ পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা, ইত্যাদি।

নেহরু দৃশ্যত এবং দৃশ্যের অন্তরালেও যে জিন্নাহ’র প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিলেন তা ফুটিয়ে তুলতে জসওয়ান্ত সিং কোনো রাখঢাক করেননি। তিনি লিখেছেন: “এটাই প্রথমবার নয় যে, সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন বোঝার বা দেখার ক্ষেত্রে নেহরু তাঁর অক্ষমতা প্রকাশ করেছিলেন। নেহরু তাঁর অনেক বক্তৃতায় বলেছেন যে, ‘সাম্প্রদায়িক সমস্যাটি ছিল শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত শ্রেনির লোকদের দ্বারা সৃষ্ট, যারা আইনসভায় কয়েকটি আসন অথবা সরকারি চাকুরি বা মন্ত্রী পদে নিযুক্তির জন্য দরকাষাকষি করতে চেয়েছেন।” কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার পর জিন্নাহ’র প্রয়োজনীতা যে কতটুকু, সে সম্পর্কে ভারতের সাধারণ মানুষের মাঝেও কোনো সন্দেহ ছিল না। শুধু জসওয়ান্ত সিং নন, ইতিহাসবিদরাও এ ধারণার সঙ্গে একমত ছিলেন যে, স্বাধীন ভারতে জিন্নাহ’র যে প্রয়োজন অনুভূত হবে তা প্রতিহত করাই ছিল কংগ্রেসের একমাত্র লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল এবং তারা জিন্নাহ বিহীন স্বাধীন ভারত নিশ্চিত করতেই ভারত বিভাগ অনিবার্য করে তুলেছিলেন।

হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করতে জিন্নাহ’র অক্লান্ত পরিশ্রম ও আন্তরিক প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছেন জসওয়ান্ত সিং। তিনি জিন্নাহ’র বহুল ব্যবহৃত একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন, যেখানে জিন্নাহ বলেছেন: “আমি নিশ্চিত যে হিন্দু-মুসলিম নির্ভেজাল এবং প্রকৃত ঐক্য ছাড়া ভারতের কোনো আশা নেই, যা অর্জিত হতে পারে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের দ্বারা। এজন্য হৃদয়ের সত্যিকার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। কেবল তখনই ভারত সমগ্র বিশ্বে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হবে এবং ভারতের কণ্ঠ যথার্থই কার্যকর হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত ভারত বিভক্ত থাকবে, ততক্ষণ লন্ডনের কাছ থেকে ভারতের জন্য গ্রহণযোগ্য পরিবর্তন আশা করা অর্থহীন।”

আরও পড়ুন-ভারতের বিস্মৃত স্বাধীনতা সংগ্রামী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ

কংগ্রেস নেতাদের আচরণে এক পর্যায়ে জিন্নাহ যে ক্ষুব্ধ হননি তা নয় এবং জসওয়ান্ত সিং তাঁর গ্রন্থে তা উল্লেখ করেছেন। তিনি ১৯৩৮ সালে আলীগড়ে জিন্নাহ’র এক বক্তৃতার উদ্ধৃতি দেন, যেখানে জিন্নাহ বলেছেন, “আমি গোলটেবিল সম্মেলনে আমার জীবনের বড়ো ধাক্কার সম্মুখীন হয়েছি। আমি বিপদের মুখ দেখেছি; হিন্দু আবেগ, হিন্দু মন, হিন্দু দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে এমন উপসংহারের দিকে নিয়ে গেছে যে, ঐক্যের আর কোনো আশা নেই। আমি আমার দেশ সম্পর্কে অত্যন্ত হতাশা অনুভব করেছি। এটা সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক একটি অবস্থা। মুসলমানরা যেন ‘নো-ম্যানস ল্যান্ডে’ আটকে আছে; হয় তারা বিৃটিশ সরকারের হাতের পুতুল অথবা কংগ্রেস শিবিরের অনুসারীদের তল্পীবাহক। যখনই মুসলমানদের সংগঠিত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে, তখনই একদিকে তোষামোদকারী ও পুতুলেরা এবং অন্যদিকে কংগ্রেস শিবিরের বিশ্বাসঘাতকরা সেই প্রচেষ্টাকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। আমি অনুভব করতে শুরু করেছি যে, আমার পক্ষে ভারতকে সাহায্য করা সম্ভব নয়, হিন্দুদের মানসিকতার পরিবর্তন করাও সম্ভব নয়।”

জসওয়ান্ত সিং বলেছেন যে, জিন্নাহ তাঁর হতাশা সত্ত্বেও ভারত বিভাগের পক্ষে ছিলেন না। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা অযোধ্যার সমৃদ্ধ এস্টেট মাহমুদাবাদের রাজা সাহেব (মোহাম্মদ আমির আহমেদ খান) এর স্মৃতিকথা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন যে, “একটি ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষে আমার অবস্থান আমাকে জিন্নাহ’র সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থায় নিয়ে আসে। তিনি আমার ধারণাগুলো পুরোপুরি অস্বীকার করেন এবং এ সম্পর্কে মুসলিম লীগের প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রকাশ্যে কোনোকিছু প্রকাশ করতে আমাকে নিষেধ করেন। কারণ তাতে জনগণের বিশ্বাস হতে পারে যে, আমার মতামতের সঙ্গে জিন্নাহ’র সংস্রব রয়েছে এবং তিনিই আমাকে এ ধরনের ধারণা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে বলেছেন। আমি যেহেতু নিশ্চিত ছিলাম যে আমার ধারণাই সঠিক, সুতরাং আমি জিন্নাহ’র অবস্থানের সঙ্গে কোনো আপস করতে চাইনি। অতএব, আমি জিন্নাহ’র অবস্থান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং প্রায় দুই বছর পর্যন্ত জিন্নাহ’র কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলাম। মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক এবং অনুষ্ঠানাদি ছাড়া তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো না।”

ভারতকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য প্রতিটি উদ্যোগের ব্যর্থতার পেছনে দায়ী ছিলেন মুখ্যত নেহরু ও প্যাটেল এবং সাধারণভাবে কংগ্রেস। এ ব্যাপারে কংগ্রেসের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য গান্ধীর একক সিদ্ধান্তই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত সময়গুলোতে কংগ্রেস গান্ধীজিকে বিচ্ছিন্ন রেখেছিল। ১৯৪৩ সালে গান্ধী যখন কারাগারে আটক ছিলেন, তখন জিন্নাহ দিল্লিতে মুসলিম লীগের উন্মুক্ত অধিবেশনে ঘোষণা করেছিলেন যে, গান্ধী যদি সত্যিই মুসলিম লীগের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় উপনীত হতে আগ্রহী হন, তাহলে এটিকে তাঁর চেয়ে আর কেউ বেশি স্বাগত জানাবে না।” একথা সত্য যে গান্ধী সবসময় ভারত বিভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং এজন্য অনেকের মতো জসওয়ান্ত সিংও গান্ধীর ঐক্য প্রচেষ্টার উল্লেখ করেছেন এবং একই ভূমিকার জন্য জিন্নাহ’র প্রশংসা করেছেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে বলেছেন, “যে রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ১৯৪৪ সালে গান্ধী-জিন্নাহ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা মুসলিম লীগের ভেতর ও বাহির থেকে জিন্নাহ’র ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। গান্ধীর সঙ্গে জিন্নাহ’র সমঝোতাকে মুসলিম লীগ “কংগ্রেসের জন্য ভারতের স্বাধীনতার পথ পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে” বলে কটাক্ষ করে। কারণ এ সময় জিন্নাহ তাঁর সহজাত অবস্থান থেকে বের হয়ে গান্ধীকে ‘মহাত্মা’ সম্বোধন করে রাজনৈতিক যুদ্ধবিরতির জন্য আবেদন করেছিলেন।

গান্ধী-জিন্নাহ আলোচনা প্রসঙ্গে গান্ধীর ব্যক্তিগত সহকারী পেয়ারেলাল নায়ার লিখেছেন, “আলোচনার মাঝখানে তিনি (জিন্নাহ) বলেন, ‘আমার মনে হয় আপনি একজন হিন্দু হিসেবে এবং হিন্দু কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে এখানে এসেছেন।’ আমি বললাম, ‘না, আমি ‘না, আমি এখানে হিন্দু বা কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে আসিনি। আমি এখানে এসেছি ব্যক্তিগতভাবে।’ আমরা আমাদের আলোচনায় ফিরে যাই। —- তিনি বলেন, ‘আমাদের একটি চুক্তিতে আসা উচিত এবং এরপর সরকারের কাছে গিয়ে তাদের বলা উচিত আমাদের চুক্তির শর্তগুলো মেনে নিতে। আমাদের সমাধান তাদের মেনে নিতে বাধ্য করা উচিত।’ আমি বলেছি যে, ‘আমি কখনও ব্রিটিশের ভারতে বিভাজন চাপিয়ে দিতে বলতে পারি না।’ জসওয়ান্ত সিং তার বইয়ে গান্ধীকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন যে, অখণ্ড ভারত সম্পর্কে গান্ধী ও জিন্নাহ মধ্যে কোনো দ্বিমত ছিল না।

এমনকি লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পাঁচ বছর পরও মুসলিম লীগ দলীয়ভাবে ভারত বিভাগের পক্ষে ছিল না, যার ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে কংগ্রেসের ভুলাভাই দেশাই এবং মুসলিম লীগের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা লিয়াকত আলী খান ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক চুক্তিতে উপনীত হন। যেহেতু গান্ধী প্রায় নিশ্চিত ছিলেন যে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ঐকমত্যে পৌছতে না পারলে ব্রিটিশ সরকার ভারতের স্বাধীনতার দাবি মেনে নেবে না, অতএব তিনি দেশাইকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌছতে। এ চুক্তিতে কেন্দ্রে অন্তবর্তী কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রস্তাব ছিল, যাতে বলা হয়েছিল কেন্দ্রীয় আইন সভায় ২০ শতাংশ আসন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর জন্য নির্ধারিত থাকবে এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সমসংখ্যক প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করবে। কিন্তু দেশাই-লিয়াকত চুক্তি ব্যর্থ হয় কংগ্রেস এ চুক্তি মানতে অস্বীকার করায়। গান্ধীর ঘনিষ্ট সহযোগী ও কংগ্রেস নেতা জামনা লাল মেহতা লিখেছেন, “সকল প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পর জিন্নাহ’র জন্য একমাত্র পাকিস্তান প্রস্তাব বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করা।” তা সত্ত্বেও কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে যদি কোনো সমতা বজায় থাকতো, তাহলে জিন্নাহ ভারতের অখণ্ডতার পক্ষে সকল উদ্যোগ সমর্থন করতেন।

জসওয়ান্ত সিং আরও লিখেছেন যে, জিন্নাহ’র বিপরীতে জওহরলাল নেহরু ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চে প্রধান অভিনেতা হওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করেছেন। যে কারণে ১৯৪৬ সালের ১৬ মে প্রকাশিত কেবিনেট মিশন পরিকল্পনায় ভারতে ফেডারেল কাঠামো বজায় রাখা, মুসলিম লীগের পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান দাবি বাতিল করা সত্ত্বেও মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনাটি গ্রহণ করে। কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা প্রায় সকল মহলে প্রশংসিত হলেও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, শীঘ্রই কংগ্রেস কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে, বিশেষ করে ধর্মের ভিত্তিতে প্রদেশগুলোর গ্রুপিং এর প্রস্তাবের বিরোধিতা করে কংগ্রেস। মুসলিম লীগ এ প্রস্তাবের কোনো অংশের পরিবর্তন চায়নি। ধারণা করা যায় যে, এর ফলে কংগ্রেসের অসদুদ্দেশ্য সম্পর্কে জিন্নাহ’র সংশয় আরও বৃদ্ধি পায়। তিনি ও মুসলিম লীগ কংগ্রেসের সঙ্গে আর কোনো সহযোগিতা করার পরিবর্তে কংগ্রেসের প্রবল বিরোধিতায় অনড় অবস্থান গ্রহণ করে। ফলে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে কোনো ঐকমত্যে পৌছার সকল সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়ে যায়। কেবিনেট মিশন সমঝোতার আরও প্রচেষ্টা চালালেও তা ব্যর্থ হয়। তবুও গণপরিষদের কার্যপ্রক্রিয়া শুরু এবং জওহরলাল নেহরুকে প্রধানমন্ত্রী করে একটি অন্তবর্তী সরকার গঠন করা হয়। মুসলিম লীগ গণপরিষদ অথবা অন্তবর্তী সরকারে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ এর সূচনা করে, যা ভারত জুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে দেখা দেয়।

আরও পড়ুন-ইমাম বুখারী, এক চোর এবং এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা

জিন্নাহ’র রাজনৈতিক অবস্থানের ব্যাপারে কট্টর দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন সরদার প্যাটেল। তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ‘আমরা যদি আমাদের অবস্থানে দৃঢ় থাকি, তাহলে মুসলমানরা সংঘাতে লিপ্ত হবে না।’ অর্থ্যাৎ তিনি মুসলমানদের যেকোনো আন্দোলন দমন করতে বল প্রয়োগ করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের ৪ মার্চ প্যাটেল তার রাজনৈতিক সহযোগী কানজি দ্বারকাদাসকে এক চিঠিতে তার মনোভাব সম্পর্কে জানান:“ … তবে আমি আপনার মতো নৈরাশ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করি না। আগামী জুন মাসের আগেই সংবিধান প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। মুসলিম লীগ যদি পাকিস্তানের ওপর জোর দেয়, তাহলে একমাত্র বিকল্প হবে পাঞ্জাব ও বাংলা বিভক্ত করা। গৃহযুদ্ধ ছাড়া তারা সমগ্র পাঞ্জাব বা সমগ্র বাংলা পেতে পারে না।”

এর আগে নেহরু পাঞ্জাবকে তিন ভাগে বিভক্ত করার সুপারিশ করেছিলেন: ‘মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা; শিখ অধ্যুষিত এলাকা; এবং মিশ্র জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা।’ কংগ্রেসের এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার তারিখটি দুর্ভাগ্যজনক ছিল, কারণ গান্ধী তখন বিহারে দাঙ্গা-উপদ্রুত এলাকায় পরিস্থিতি শান্ত করার অভিযানে নিয়োজিত ছিলেন; মাওলানা আবুল কালাম আজাদ অসুস্থতার কারণে অনুপস্থিত ছিলেন। সরদার প্যাটেল এবং নেহরু উভয়েই জানতেন যে, এই অনুপস্থিত দুই ব্যক্তি তাদের বিভাজন পরিকল্পনার বিরোধিতা করবেন। প্রায় তিন সপ্তাহ পর গান্ধী নেহরুকে একটি চিঠি লিখে এই প্রস্তাব গ্রহণের কারণ জানতে চান। একই সঙ্গে তিনি প্যাটেলকেও লিখেন প্রস্তাবটি ব্যাখ্যা করার জন্য।

এই প্রস্তাবটি ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অবস্থান ও কৌশলের মৌলিক পরিবর্তন। মাউন্টব্যাটেন ইতোমধ্যে ভাইসরয় হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তিনি মূল্যায়ন করেন যে, প্যাটেল পাঞ্জাব বিভাজনের পক্ষে এবং পাঞ্জাবকে তিন ভাগে বিভক্ত করা সম্পর্কিত নেহরুর প্রস্তাবকে সমর্থন করেছেন। জওহরলাল নেহরুর পাঞ্জাব বিভাগ তথা ভারত বিভাগের যে প্রস্তাব দিয়েছেন, এর বিরোধিতাও ইতোমধ্যে প্রশমিত হয়েছে। এই প্রস্তাবের মাধ্যমে তিনি আরএসএস’এর বীর সাভারকর, কংগ্রেসের লালা লাজপত রায় এবং মুসলিম লীগের মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাগ বাস্তবায়নের ধ্বংসাত্মক ইতিহাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কংগ্রেসের জন্য এটি ন্যাক্কারজনক দৃষ্টান্ত ছিল যে, একটি সংগঠন, যারা মাত্র ত্রিশ বছর আগে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল, সেই কংগ্রেসই এখন ভারত বিভাগের প্রস্তাব উঠিয়েছে এবং তা সফলভাবে কার্যকর করেছে।

গ্রন্থের শেষদিকে জসওয়ান্ত সিং জিন্নাহ’র ভূমিকা সম্পর্কে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী রাম মনোহর লোহিয়া’র “গিল্টি ম্যান অফ ইন্ডিয়া’র পার্টিশন” গ্রন্থ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি দিয়েছেন: “এই নেহরু এবং প্যাটেল গান্ধীজির প্রতি আপত্তিকরভাবে আক্রমণাত্মক ছিলেন। তাদের উভয়ের সঙ্গে আমার বেশ উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে, যার কিছু আমি এখন বলতে চাই, যা তখন আশ্চর্যজনক মনে হয়েছিল। যদিও এখন আমি কিছুটা ভালোভাবে বুঝতে পারি, তা হলো, শিষ্য হিসেবে তারা তাদের গুরুর প্রতি অত্যন্ত রুক্ষ আচরণ ছিল। যখনই তারা আঁচ করতেন যে, গান্ধীজি তাদের উদ্যোগে বাধা দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন তারা হিংস্রভাবে ঘেউ ঘেউ করেছেন “

জসওয়ান্ত সিং আরও উল্লেখ করেছেন যে, কবি ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ড. মুহাম্মদ ইকবালকে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণার প্রবর্তক বলে মনে করা হয় এবং বিশ্বাস করা হয় যে তিনি এই আন্দোলনে প্রয়োজনীয় মানসিক উপাদানের যোগান দিয়েছেন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ একবার মন্তব্য করেছিলেন যে, তিনি একা তাঁর সেক্রেটারি এবং তার টাইপরাইটারের সাহায্যে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান অর্জন করেছিলেন। কিন্তু সবকিছু সত্ত্বেও অন্য কেউ নয়, পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং সরদার বল্লভভাই প্যাটেল।

লেখকঃ উইকলি বাংলাদেশ, নিউইয়র্ক এর উপদেষ্টা সম্পাদক, অনুবাদক, লেখক এবং প্রবাসী বাংলাদেশী, ইউএসএ

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প  ও কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

ফেসবুকে লেখক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

আরও পড়ুন