Ads

ভারত বিভাগের দাবি রাজনৈতিকভাবে ভ্রান্ত ।। মাঃ আজাদ

।। আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ।।

১৯৪৬ সালে মাওলানা আজাদের সাক্ষাৎকার:

১৯৪৬ সালের এপ্রিলে কেবিনেট মিশন ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতার সম্ভাব্য কাঠামো নিয়ে আলোচনা করছিলেন। গান্ধী যে কোনও মূল্যে দেশ বিভাগ প্রতিহত করতে চেয়েছেন। কিন্তু অন্যান্য কংগ্রেস নেতা, যাদের সরকার পরিচালনা করতে হবে তারা জিন্নাহর ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছিলেন, যাতে তিনি ভারতের মধ্যেই থাকেন। ১৯৪৬ সালের ১৭ জুলাই মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এক বিবৃতিতে বলেন, “একসময় মুসলমানরা রাতারাতি জেগে উঠে আবিস্কার করবে যে তারা বিদেশিতে পরিণত হয়েছে; তাদের কোনো শিল্প নেই এবং তারা শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে; তারা নির্ভেজাল এক হিন্দু রাজের কৃপার শিকারে পরিণত হবে।” মাওলানা আজাদ কি অতিরঞ্জিত বলেছেন, অথবা তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন? এ বিষয়ে ভারতের আর কোনো জাতীয় নেতার মাওলানা আজাদের মতো এত স্বচ্ছ দৃুষ্টিভঙ্গি ছিল না।

কেবিনেট মিশনের সঙ্গে বৈঠক চলাকালে মাওলানা আজাদ কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। এ সময় ১৯৪৬ এর এপ্রিলে তিনি লাহোরের (তখন ভারতের অন্তর্ভুক্ত) সাপ্তাহিক উর্দু ম্যাগাজিন ‘চাট্টান’ এর সম্পাদক আগা শোরিস কাশ্মিরীকে এক সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে, ‘ধর্মীয় সংঘাত পাকিস্তানকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে এবং এর পূর্বাঞ্চল তার নিজস্ব ভবিষ্যৎ খুঁজে নেবে।’ তিনি একথাও বলেছিলেন যে, ‘পাকিস্তানের অযোগ্য নেতারা হয়তো দেশে সামরিক শাসনের পথ করে দেবে।’ শোরিস কাশ্মিরীর মতে, মাওলানা আজাদ তাঁকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য সকালের প্রথম প্রহর নির্ধারণ করেছিলেন এবং সাক্ষাৎকার শেষ করতে দুই সপ্তাহ লেগেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, সাক্ষাৎকারটি কোনো গ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত হয়নি। ওই সময়ের ঘটনার উচ্ছাস ও উন্মাদনার মধ্যে তার সাক্ষাৎকারের বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল এবং সকলে বিস্মৃতও হয়ে গিয়েছিল।

‘মাতবুআত চাট্টান’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা থেকে ‘আবুল কালাম আজাদ’ নামে শোরিস কাশ্মিরীর নিজস্ব গ্রন্থে সাক্ষাৎকারটি অন্তর্ভূক্ত ছিল এবং গ্রন্থটি একবার মাত্র মুদ্রিত হয়েছিল। ভারতের সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আরিফ মুহাম্মদ খান অনেক অনুসন্ধানের পর গ্রন্থটি উদ্ধার করতে সক্ষম হন এবং পাক্ষিক ‘কোভার্ট ম্যাগাজিন’ এর জন্য সাক্ষাৎকারটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এ সাক্ষাৎকারে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের বক্তব্যের স্পষ্টতা ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, “অখণ্ড ভারতে মুসলমানদের প্রতিটি অধিকার দাবির সাংবিধানিক রক্ষাব্যবস্থা থাকবে, কিন্তু ভারত বিভাজনে তারা তাদের স্বার্থের বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হবে না। সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের জন্য দেশ বিভাগের দাবি রাজনৈতিকভাবে ভ্রান্ত ধারণা।”

আরও পড়ুন-জিন্নাহ নয়, পাকিস্তানের স্রষ্টা নেহরু ও প্যাটেল

আগা শোরিস কাশ্মিরী মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে প্রশ্ন করেন যে, তিনি কি মনে করেন না যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। মাওলানা উত্তর দেন: “পাকিস্তানের সৃষ্টি কোনো সমস্যার সমাধান করবে না। একজন মুসলমানের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হলো ইসলামের বিস্তার ঘটানো। মুসলমানরা যদি সূচনাকাল থেকে পৃথিবীকে মুসলিম এবং অমুসলিম ভূখণ্ডে বিভক্ত করতো, তাহলে ইসলাম কখনও সম্প্রসারিত হতো না। মুসলিম রাজনীতিবিদরা যদি আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার না করতো, তারা যদি হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ফাটল বৃদ্ধি করার ব্রিটিশ চক্রান্তে সহযোগিতা না করতো, তাহলে ভারতে ইসলামের সম্প্রসারণ আরও বেশি হতো।”

তিনি আরও বলেন, “ব্রিটিশ প্রভাবের অধীনে আমরা ইসলামকে একটি গণ্ডিবদ্ধ ব্যবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছি এবং ইহুদি, পার্সি এবং হিন্দুদের মতো অন্যান্য সম্প্রদায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমরা নিজেদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্প্রদায়ে রূপান্তরিত করেছি। ভারতীয় মুসলমানরা ইসলাম ও ইসলামের বাণীকে জমাটবদ্ধ করে ফেলেছে এবং নিজেদের বহু শ্রেণিতে বিভক্ত করেছে। এমনকি কোনো কোনো শ্রেনি সুস্পষ্টভাবে ঔপনিবেশিক শক্তির পরিকল্পনার অধীনে সৃষ্টি হয়েছে। পরিণতিতে এইসব শ্রেনি নিজেদের সকল আন্দোলন ও গতিশীলতার বাইরে থাকাকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং ইসলামী মূল্যবোধে তাদের বিশ্বাস হারিয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “উলেমারা পাকিস্তানে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে, কিন্তু ইসলাম তার নিজস্ব ঔজ্জ্বল্য হারাবে।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী যখন উল্লেখ করেন যে উলেমারাও জিন্নাহর পক্ষে রয়েছেন, মাওলানা আজাদ বলেন, “যারা মোগল সম্রাট আকবরের জন্য নতুন ধর্ম ‘দ্বীন-ই-ইলাহি’ উদ্ভাবন করেছিলেন, তারাও উলেমা ছিলেন। যেসব উলেমা ইতিহাসে সম্মানজনক আসন লাভ করেছেন, তাদের সংখ্যা এক হাতের আঙুলের ডগায় গণনা করা যাবে, ইমাম হাম্বল, ইবনে তাইমিয়া এবং ভারতে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি এবং তার পরিবার। মুজ্জাদ্দিদ আলফ সানি একজন সাহসী আলেম ছিলেন, কিন্তু যারা তাকে কারারুদ্ধ করতে ভূমিকা রেখেছিলেন, তারাও আলেম ছিলেন। ওইসব আলেম এখন কোথায়? কেউ কি তাদের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা পোষণ করে?”

তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে সমস্যা কোথায়? শত হলেও এর ফলে তো মুসলমানদের ঐক্য সংরক্ষিত হবে। মাওলানা আজাদ বলেন:

“পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে সকল হিন্দু পাকিস্তান ত্যাগ করবে। কিন্তু সকল মুসলমানকে পাকিস্তানে স্থান দেওয়া সম্ভব হবে না। অন্তত তিন কোটি মুসলমানকে ভারতে রয়ে যেতে হবে। তাদের জন্য তিনটি পথ খোলা থাকবে: তারা পাকিস্তানে চলে যেতে পারে; যে প্রজন্ম ভারত বিভাগের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, তারা পৃথিবী থেকে বিদায় না হওয়া পর্যন্ত ভারতে রয়ে যাওয়া মুসলমানদের দাঙ্গার শিকার হতে হবে; অথবা তাদেরকে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত হতে হবে। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত হবে বাইরের শক্তি দ্বারা; ভারতকে তাদের শাসন নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে না, কারণ তারা পাকিস্তানের পক্ষ থেকে শত্রুতা দমন করতে সক্ষম হবে। জিন্নাহ এবং লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং পশ্চিম পাকিস্তান আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সংঘাতের উন্মুক্ত ভূমিতে পরিণত হবে। মুসলমান ব্যবসায়ীরা পাকিস্তান চাইছে, কারণ তারা প্রতিযোগিতাকে ভয় করছে।”

‘চাট্টান’ ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী শোরিস কাশ্মিরী মাওলানা আজাদকে আরও বলেন যে, মুসলমানরা পাকিস্তানে তাদের সাম্প্রদায়িক পরিচিতি অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হবে এবং ভালো মুসলিম নাগরিক হতে পারবে। এর প্রেক্ষিতে মাওলানা আজাদ বলেন: “মুসলমানরা তো ব্রিটিশ শাসনের অধীনেই তা করেছে, সেক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ভারতে তাদের মুসলিম পরিচিতি ও মুসলিম নাগরিক হওয়ার ক্ষেত্রে ভীতির সৃষ্টি হওয়ার কারণ কি ছিল, যে গণতন্ত্রে তাদের দৃঢ় কণ্ঠের গ্যারান্টি থাকবে? ভারতের সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলো (বাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধ ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ) মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সেই প্রদেশগুলোর সীমান্ত মুসলিম দেশের সঙ্গে। অতএব মুসলমানদের কোনোভাবেই নির্মূল করা সম্ভব নয়। জিন্নাহ স্বয়ং ‘হিন্দু মুসলিম ঐক্যের দূত’ ছিলেন। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত তিনি দেশ ভাগের বিরোধিতা করেছেন। এরপর কংগ্রেস সাতটি প্রদেশে তাদের সরকার গঠন করে এবং মুসলিম লীগকে বাদ দেয়। মুসলমানদের রাজনৈতিক অবক্ষয় রোধের চেষ্টায় ১৯৪০ সালে জিন্নাহ পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণ করেন।”

আরও পড়ুন-ভারতের বিস্মৃত স্বাধীনতা সংগ্রামী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ

মাওলানা আজাদকে প্রশ্ন করা হয়, মুসলমানরা যুক্তির প্রতি এতটা বধির ও অনড় কেন, তিনি উত্তর দেন যে মুসলমানদের উচ্ছৃঙ্খল জনতার উৎসাহের পর্যায়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কোনো জনগোষ্ঠী যখন নিজেদের ওপর আস্থা ও আত্মমর্যাদাবোধ হারিয়ে ফেলে তখন কল্পিত সংশয় ও বিপদের আশঙ্কা তাদের ঘিরে ফেলে এবং তারা সঠিক ও ভুলের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু সত্য হচ্ছে, জীবনের প্রকৃত অর্থ পরিপূরণ হয় দৃঢ় বিশ্বাস ও ন্যায়নিষ্ঠ কাজের মাধ্যমে, সংখ্যার শক্তিতে নয়। ভারতের মুসলমানরা যদি বিপদের মধ্যে বসবাস করে, তাহলে দেশকে বিভক্ত করে এই বিপদকে দূর করা সম্ভব হবে না, এ বিপদ তাদেরকে সীমান্ত পর্যন্ত তাড়া করবে এবং তাদেরকে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত করবে, এবং সেই সংঘাতে আরও অসংখ্য মানুষের জীবনহানি ঘটবে।

‘চাট্টান’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে যখন প্রশ্ন করেন যে, হিন্দু ও মুসলমানরা বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ও বাঁকে সবসময় দুটি ভিন্ন জাতি ছিল, কীভাবে তাদের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব? মাওলানা উত্তরে বলেন, “স্বাধীনতা একটি আশীর্বাদ, প্রতিটি নাগরিকের অধিকার; এটিকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করা সম্ভব নয়। মুসলমানরা নিজেদের মধ্যেই বহুসংখ্যক প্রতিবন্ধকতা দ্বারা বিভক্ত। মুসলমানদের মধ্যে ওয়াহাবী, সুন্নী ও শিয়া রয়েছে এবং এর বাইরেও বিভিন্ন দরবেশ ও বিশ্বাসের প্রতি অনুগত আরও অনেক শ্রেণী আছে। তাদের কাছে ইসলামে আনুগত্যের অর্থ হলো, তাদের নিজ নিজ শ্রেণীর প্রতি আনুগত্য। তাদের মধ্যে এমনকি নামাজের সময় হাত তোলা এবং শব্দ করে ‘আমিন’ বলার উচ্চারণ করার মতো ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে সমাধানের অযোগ্য সংকট সৃষ্টি হওয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে। উলেমারা ‘তাকফীর’ (মানুষকে ‘কাফির’ চিহ্নিত করা) প্রয়োগ করে বিবাদ নিস্পত্তির চেষ্টা করেন। একসময় মুসলমানরা ইসলামকে অবিশ্বাসীদের কাছে নিয়ে গেছে, এখন তারা ইসলামকে বিশ্বাসীদের কাছ থেকে দূরে নিয়ে গেছে। মুসলমানরা ধর্মের চেয়ে রাজনীতিকে প্রাধান্য দিতে এবং পার্থিব উচ্চাভিলাষকে ধর্মীয় আদেশ হিসাবে অনুসরণ করতে এসেছে।”

সবশেষে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী মাওলানা আজাদের কাছে জানতে চান যে, তিনি তাঁর ম্যাগাজিন আল-হিলাল বন্ধ করে দিয়েছেন কেন — তিনি কি মনে করেছেন যে তিনি এক উষর মরুভূমিতে আজান দিচ্ছিলেন। মাওলানা আজাদ বরং তাকে পাল্টা বলেন যে, আল-হিলাল ম্যাগাজিন সম্পাদনার কাজ তাঁর জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে; এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি অনুভব করেছেন যেন তিনি নবী মুহাম্মদ সা: এর সাহাবিদের একজন। তিনি বলেন, “আমার নিজের কণ্ঠ আমাকে মুগ্ধ করেছে এবং আমি ভস্ম থেকে ফিনিক্স পাখির মতো আবির্ভূত হয়েছি।”

কিন্তু তিনি উপসংহার টানেন যে, এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর স্বাধীনতা নির্ভর করে ভারতের স্বাধীনতার ওপর এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ভারতের স্বাধীনতার চাবিকাঠি। এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে আমি উপলব্ধি করেছি যে, ভারত অবশ্যই স্বাধীনতা অর্জন করবে এবং পৃথিবীর কোনো শক্তি এটি অস্বীকার করতে পারে না। আমি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে আশা করি যে, মুসলমানরা তাদের দেশবাসীর সঙ্গে একত্রে পথচলা শিখবে এবং ইতিহাসকে একথা বলার সুযোগ দেবে না যে, ভারত যখন তাদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছিল, তখন ভারতের মুসলমানরা কেবল দর্শকের মতো দেখছিল। কেউ যাতে বলতে না পারে যে প্রবল স্রোতের বিরুদ্ধে লড়ার পরিবর্তে তারা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা যোদ্ধাদের বহনকারী নৌকা ডুবে যেতে দেখে আনন্দ করেছে।”

আরও পড়ুন-মুসলমানের রক্তে লেখা ভারতের স্বাধীনতা

ভারতের স্বাধীনতার আগে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ১৯৪০ সাল থেকে টানা ছয় বছর অল ইন্ডিয়া কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। তিনি দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য কংগ্রেস সভাপতি হতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ১৯৪৬ সালে মহাত্মা গান্ধী তাঁকে অনুরোধ করেন জওহরলাল নেহরুকে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য। মাওলানা আজাদ গান্ধীজির পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং তাঁর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। তিনি তখনও কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন এবং কমিটি যখন দেশ বিভাগ প্রস্তাব গ্রহণ করে তখন তিনিও এর অংশ ছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তিনি কখনও দেশ বিভাগ মেনে নেননি। বরং তিনি জওহরলাল নেহরুকে সতর্ক করেছিলেন যে, তার কিছু পদক্ষেপ রাজনৈতিকভাবে বিজ্ঞোচিত নয় এবং এ কারণে হয় জিন্নাহ’র কাছ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হবে, অথবা দেশ বিভাগ অনিবার্য হয়ে পড়বে। কিন্তু নেহরু একটি দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকার মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না বলে সচেতনভাবে ভারত বিভাগে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

কিন্তু দেশ বিভাগে মাওলানা আজাদের কোনো আগ্রহ ছিল না এবং তিনি দেশ বিভাগ প্রতিহত করতে চেয়েছেন। কিন্ত এটি অনিবার্য হয়ে উঠলে এ প্রস্তাব সমর্থন করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না। কংগ্রেসের সবচেয়ে কমবয়সী সভাপতি হিসেবে রামগড় অধিবেশনে ভাষণ দানকালে তিনি বলেছিলেন: “যদি কোনো ফেরেশতাও বেহেশত ভারতের স্বাধীনতার উপহার নিয়ে অবতীর্ণ হয় এবং কুতুব মিনার থেকে ঘোষণা করে যে, ভারত একটি স্বাধীন দেশ, তাহলেও আমি তা গ্রহণ করবো না, যদি হিন্দু-মুসলমান এক না হয়। ভারত যদি স্বাধীনতা না পায়, তাহলে অবশ্যই ভারতের ক্ষতি হবে, কিন্তু হিন্দু-মুসলমান যদি এক না হয় তাহলে সমগ্র মানবতার ক্ষতি হবে।”

কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৪৬ সালের ১০ জুলাই জওহরলাল নেহরু বোম্বেতে তার প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্যে ভারত বিভাগকে অনিবার্য করে তোলেন মুসলিম লীগ নেতৃত্বের কাছে কংগ্রেসের পরিকল্পনা সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে। সভাপতি হিসেবে তাঁর প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে নেহরু বলেন যে, কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা পরিবর্তন করা যেতে পারে। অথচ মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয় দলই কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। তাঁর বক্তব্য ছিল উদ্দেশ্যমূলক, তিনি চেয়েছিলেন যে, মুসলিম লীগ যাতে দেশ বিভাগ মেনে নিতে বাধ্য হয়। নেহরুই জিন্নাহকে দেশভাগের পথে যেতে বাধ্য করেন। কেবিনেট মিশন পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য, যা ১৯৪৬ সালের ১৬ মে ঘোষণা করা হয়, সেটি ছিল একটি অখণ্ড ভারত নিশ্চিত করার জন্য। ভারতকে বিভক্ত না করেই স্বাধীনতা লাভ করা।

মুসলমানদের ভারতের স্বাধীন ভারতের মূলধারার অংশে পরিণত করতে মাওলানা আজাদের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা ভারতের স্বাধীনতাকালে ব্যর্থ প্রমাণিত হলেও পরবর্তী ইতিহাস নিষ্ঠুর সুক্ষ্মতায় তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীই অনুসরণ করেছে। একটি বিষয় ছাড়া ভারতের ব্যাপারেও তার কথার যথার্থতা প্রমাণিত হয়েছে। তিনি ধারণা করতে পারেননি যে, ভারতে মুসলমানরা কখনও দরিদ্র, পশ্চাদপদ সম্প্রদায়ে পরিণত হবে। যেসব মুসলিম পাকিস্তানে না গিয়ে ভারতে অবস্থান করাকে প্রাধান্য দিয়েছিল, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল দরিদ্র। কিন্তু এটাই তাদের পিছিয়ে পড়ার একমাত্র কারণ ছিল না। স্বাধীন ভারতে অনানুষ্ঠানিক বৈষম্য ছিল, যা এখনও আছে এবং এর চড়া মূল্য দিচ্ছে ভারতের মুসলমানরা।

জিন্নাহ’র প্রশংসা করে বিজেপি সভাপতির পদ হারান আদভানি:

ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সভাপতি হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে দায়িত্ব পালনকারী কট্টরপন্থী হিন্দু নেতা এল.কে আদভানি ২০০৫ সালে কায়দে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে ‘এক মহান ব্যক্তি’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষ নেতা’ অভিহিত করে প্রশংসা করায় তাঁকে দলের সভাপতির পদ হারাতে হয়েছিল। ২০০৫ সালের জুন মাসে করাচি সফরকালে আদভানি জিন্নাহ’র মাজার পরিদর্শন করেন। পাকিস্তান নৌবাহিনীর একটি দল মাজার প্রাঙ্গনে তাঁকে গার্ড অফ অনার দেয় এবং তিনি মাজারের পরিদর্শন বহিতে লিখেন: “এমন অনেক মানুষ থাকেন, যারা ইতিহাসে অমোচনীয় ছাপ রেখে যান, কিন্তু খুব কম সংখ্যক লোক থাকেন, যারা প্রকৃতপক্ষে ইতিহাস সৃষ্টি করেন।” তিনি আরও লিখেন, “কায়দে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এমনই একজন বিরল ব্যক্তি। তাঁর প্রাথমিক বছরগুলোতে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃস্থানীয় এক ব্যক্তিত্ব সরোজিনী নাইডু জিন্নাহকে ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত’ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।”

আরও পড়ুন-ইতিহাসের অজ্ঞতা গোলামী ডেকে আনতে পারে ।। ১ম পর্ব

বিজেপি প্রধান লাল কৃষ্ণ আদভানি জিন্নাহ’র প্রতি তার প্রশংসা অব্যাহত রাখেন এবং বলেন, “১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট পাকিস্তানের গণপরিষদে প্রদত্ত জিন্নাহ’র ভাষণ ছিল অত্যন্ত বৈশিষ্টমণ্ডিত, একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রতি জোরালো সমর্থন, যেখানে প্রতিটি নাগরিক স্বাধীনভাবে তার নিজস্ব ধর্ম পালন করবে; কিন্তু রাষ্ট্র বিশ্বাসের ভিত্তিতে একজন নাগরিকের সঙ্গে আরেকজন নাগরিকের মধ্যে কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করবে না। এই মহান ব্যক্তির প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।” জিন্নাহর মাজারের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ভারত বিভাগকে “ইতিহাসের অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা” হিসেবে মেনে নেন। জিন্নাহ যে রাষ্ট্র এবং ধর্মকে পৃথক রাখায় বিশ্বাস করতেন তা ইতিহাসে সুপ্রতিষ্ঠিত ঘটনা হলেও সংঘ পরিবারে আদভানিই প্রথম নেতা, যিনি এ সত্য স্বীকার করেন।

বিজেপি তাদের সভাপতির বক্তব্য থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখে, কিন্তু বিজেপি’র আদর্শিক উৎস আরএসএস প্রকাশ্যে আদভানির বক্তব্যের সঙ্গে তাদের মতানৈক্য প্রকাশ করে। দলের পক্ষ থেকে তাঁকে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করতে বলা হলে তিনি ভারতে ফেরার পরই বিজেপি সভাপতির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। অবশ্য রাজনাথ সিং তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি কয়েক মাস পদে ছিলেন।

উল্লেখ্য, রাম জন্মভূমি আন্দোলনের মুখ্য নেতা এল কে আদভানি, যিনি ১৯৯২ সালে সোমনাথ থেকে রথযাত্রা শুরু করে হিন্দু পুনর্জাগরণের পাশাপাশি ভারতে মুসলিম বিদ্বেষ উসকে দেওয়া এবং সে বছরের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসে অবদান রেখেছেন, তাঁর করাচি সফর ছিল আবেগঘন ব্যাপার। কারণ তিনি ১৯২৭ সালে করাচিতে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই তিনি আরএসএস এ দীক্ষা গ্রহণ করেন। কলেজে পড়াশোনা করার সময় তিনি সিন্ধে আরএসএস এর ‘প্রচারক’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

জিন্নাহ’র মাজার প্রকল্পের কেয়ারটেকার এল কে আদভানিকে মাজার সম্পর্কিত একটি পুস্তিকা প্রদান করেন, যাতে আরও কঠোর বক্তব্য ছিল:

“একটি পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজনীয়তা এতটাই অনিবার্য হয়ে ওঠেছিল, কারণ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে মুসলমানদের জন্য ইসলামের নীতি অনুসারে মুক্ত ও নিরবচ্ছিন্ন জীবনযাপন করা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাই কয়েক বছরের স্বল্প সময়ের মধ্যে, কায়েদ (মুসলিম) লীগের সবুজ পতাকা তলে ভারতীয় মুসলমানদের সমবেত করেন এবং পাকিস্তান আন্দোলনকে এমন গতি প্রদান করেন, যা ব্রিটিশ সরকার বা ভারতীয় কংগ্রেস ধারণ করতে পারেনি।”

লেখকঃ উইকলি বাংলাদেশ, নিউইয়র্ক এর উপদেষ্টা সম্পাদক, অনুবাদক, লেখক এবং প্রবাসী বাংলাদেশী, ইউএসএ

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প  ও কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

ফেসবুকে লেখক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

আরও পড়ুন