Ads

দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণমুখী সংসার গঠনে নারীর ভূমিকা

।। ড. মোহাঃ ইয়ামিন হোসেন ।।

দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য কল্যাণমুখী সংসারে একজন নারীর ভূমিকা আল কোরআন ও হাদিসের আলোকে বিশদভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। আল কোরআন ও হাদিসে নারীর ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।

আল কোরআনের আলোকে নারীর ভূমিকা

মা হিসেবে ভূমিকা

আল কোরআনে মায়ের মর্যাদা অত্যন্ত উচ্চে। মা তার সন্তানদের জন্ম দেয়, লালন-পালন করে, এবং তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করে। আল্লাহ্‌ বলেন,

“আর আমরা মানুষকে তার মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি; তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করেছেন এবং তার দুধ ছাড়ানো হয়েছে দুই বছরে। সুতরাং, আমার প্রতি এবং তোমার মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। আমার কাছেই প্রত্যাবর্তন।” (সূরা লুকমান, আয়াত ১৪)

এই আয়াতে মায়ের কষ্ট ও ত্যাগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং সন্তানদের প্রতি তাদের দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে।

স্ত্রী হিসেবে ভূমিকা

একজন স্ত্রী সংসারের শান্তি ও স্থিতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। আল কোরআনে বলা হয়েছে,

“তোমাদের মধ্যে একজনের জন্য অন্যজনের পরিপূরক সৃষ্টি করা হয়েছে। যাতে তোমরা শান্তি পাও। আর আল্লাহ্‌ তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা রূম, আয়াত ২১)

এখানে স্ত্রীর ভূমিকাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়েছে, কারণ স্ত্রী সংসারের শান্তি ও সুখের অন্যতম কারণ।

হাদিসের আলোকে নারীর ভূমিকা

মা হিসেবে ভূমিকা

মায়ের মর্যাদা ও দায়িত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিসে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। রাসূল (সা.) বলেন, “জান্নাত মায়ের পদতলে।” (নাসাঈ, ৩১০৪)। এই হাদিসে মায়ের মর্যাদাকে অত্যন্ত উচ্চে তুলে ধরা হয়েছে এবং সন্তানদের প্রতি মায়ের কর্তব্যের গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে।

স্ত্রী হিসেবে ভূমিকা

রাসূল (সা.) বলেন, “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম, যে তার পরিবারের জন্য উত্তম। আর আমিই আমার পরিবারের জন্য উত্তম।” (তিরমিজি, ৩৮৯৫)। এই হাদিসে স্ত্রীদের প্রতি স্বামীর কর্তব্য ও তাদের মর্যাদা সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্বামীদের প্রতি পরিবারের মধ্যে উত্তম আচরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

আখিরাতমুখী সংসার গঠনে দুনিয়ায় নারীর ভূমিকা কেমন হতে পারে তা নিম্নোক্ত প্রধান বিষয় যেমন নারীর ঘরোয়া ভূমিকা, সমাজে নারীর ভূমিকা, ইবাদত ও নৈতিকতা এবং পরিবার ও সন্তানদের প্রতি দায়িত্বশীলতা কেন্দ্র করে উপস্থাপন করা হলো-

আরও পড়ুন-

সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে মহিলাদের ভূমিকা

১। নারীর ঘরোয়া ভূমিকা

আল কোরআনে নারীর ঘরোয়া ভূমিকা সম্পর্কে বেশ কিছু আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন:

“আর তোমরা তোমাদের ঘরে অবস্থান কর এবং পূর্ববর্তী জাহিলিয়াতের (অজ্ঞতার যুগের) মত সাজসজ্জা প্রকাশ কর না।” (সূরা আল আহযাব-৩৩)

এই আয়াতে পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে যে, নারীরা তাদের ঘরের মধ্যে অবস্থান করবে এবং নিজের সাজসজ্জা প্রকাশ করে সমাজে প্রভাব ফেলবে না।

হাদিসে  নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন,

“সর্বোত্তম নারীরা সেই নারী যারা তাদের স্বামীর জন্য সবচেয়ে ভাল স্ত্রী হয় এবং তাদের সন্তানের জন্য সবচেয়ে ভাল মা হয়।”

২। সমাজে নারীর ভূমিকা

আল কোরআনে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমান অধিকারের উল্লেখ রয়েছে। আল কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ এবং এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পার।” (সূরা হুজরাত-১৩)

হাদিসে নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, “জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরজ।” (ইবনে মাজাহ)

এই হাদিস থেকে স্পষ্ট যে, ইসলামে নারীদের জ্ঞান অর্জনের অধিকার রয়েছে এবং  পুরুষের মতো জ্ঞান অর্জন করা তার জন্যও ফরজ । আর পুরুষের ন্যায় সমাজিক উন্নয়নে নারীদেরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিত।

৩। ইবাদত ও নৈতিকতা

আল কোরআনের আলোকে নারীদের ইবাদত ও নৈতিকতায় পূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা বলা হয়েছে যেমন,

আল কোরআন বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারী, মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনয়ী পুরুষ ও বিনয়ী নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, রোজাদার পুরুষ ও রোজাদার নারী, তাদের লজ্জাস্থান হেফাজতকারী পুরুষ ও লজ্জাস্থান হেফাজতকারী নারী এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও স্মরণকারী নারী- তাদের জন্য আল্লাহ্ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।” (সূরা আহযাব-৩৫)

হাদিসের আলোকে নারী পুরুষ উভয়কেই তাকওয়াবান এবং সৎ হবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, “আল্লাহকে সর্বোচ্চ ভয় কর এবং প্রতিটি কাজেই সৎ হও।”

আরও পড়ুন-

নারীর সত্যিকারের স্বাধীনতা আসে যেভাবে

৪. পরিবার ও সন্তানদের প্রতি দায়িত্বশীলতা

আল কোরআনের আলোকে সন্তান প্রতিপালনে মায়ের অনেক ভূমিকা রয়েছে । সন্তানদের প্রতিপালনে মায়ের গুরুত্ব সম্পর্কে  আল কোরআন বলা হয়েছে , “আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে এবং তার দুধ ছাড়ানো দু বছরে হয়…।” (সূরা লোকমান-১৪)

হাদিসের আলোকে হাদিস: নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, “মা’র পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।” এই হাদিস থেকে স্পষ্ট যে, সন্তানের জীবনে মায়ের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

৫। শিক্ষাদান ও জ্ঞানার্জন

নারীদের জ্ঞান অর্জন ও তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে আল কোরআন ও হাদিসে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, “জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নারী ও পুরুষের জন্য ফরজ।” (ইবন মাজাহ, ২২৪)। এই হাদিসে নারীদের জন্য শিক্ষার গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে।

৬। নৈতিক শিক্ষা:

মায়ের দায়িত্ব হল সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা দেয়া। এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মা তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে।

৭। ধর্মীয় বিধান মেনে চলা

ধর্মীয় বিধান মেনে চলা একজন নারীর দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ নিশ্চিত করার অন্যতম উপায়। আল কোরআনে বলা হয়েছে, “হে নবী, বলুন আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মুমিনদের নারীগণকে যেন তারা তাদের উপরিভাগের চাদর দিয়ে নিজেদেরকে ঢেকে রাখে; এটি তাদেরকে চেনার জন্য এবং উত্ত্যক্ত না হওয়ার জন্য উত্তম। আর আল্লাহ্‌ পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা আহযাব-৫৯)।

ইসলামের দৃষ্টিকোণে একজন নারীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুমুখী। আল কোরআন ও হাদিসে নারীদের সম্মান, অধিকার এবং দায়িত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। একজন নারী দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণমুখী হতে পারেন যদি তিনি তার ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্বগুলি সঠিকভাবে পালন করেন। ইসলামে নারীর ভূমিকা কেবলমাত্র পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে তার অবদান অপরিহার্য। এই স্বল্প আলোচনার মাধ্যমে আল কোরআন ও হাদিসের আলোকে একজন নারীর দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণমুখী ভূমিকার সার্বিক চিত্র সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।

লেখকঃ প্রাবন্ধিক এবং অধ্যাপক, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় 

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প  ও কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

ফেসবুকে লেখক  মোঃ ইয়ামিন হোসেন 

আরও পড়ুন