Ads

যে কারণে চাকুরীর বাজারে পুরুষের চেয়ে নারীরা পিছিয়ে

।। শারমিন আকতার ।।

শিক্ষা গ্রহণে নারীরা অতীতে পিছিয়ে থাকলেও বর্তমানে নারী শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে। এবারও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর দেখা যায় পাশের হার ও জিপিএ ফাইভে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে।২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলেও দেখা যায় মেয়েদের পাসের হার ছেলেদের চেয়ে বেশি। এমনকি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও তুলনামূলকভাবে নারীরা অনেক এগিয়ে গেছে।

শিক্ষাজীবনে নারীরা এগিয়ে থাকলেও চাকুরীর বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা যেমন বিসিএস, সরকারী ও বেসরকারি ব্যাংকসহ নানা পরীক্ষায় নারীরা ততোটা এগিয়ে নেই । বিসিএসের মাধ্যমে সরকারি চাকুরীর নিয়োগে নারীরা পুরুষের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে । গত ৬টি সাধারণ বিসিএসের গড় হিসাব করলে দেখা যায় যে প্রতি ১০০ ক্যাডার পদের বিপরীতে ৭৫ টিতেই নিয়োগ পেয়েছে পুরুষ, আর নারী মাত্র ২৫ টিতে । অ্যাকাডেমিক বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফলে মেয়েরাই এগিয়ে থাকলেও শিক্ষা গ্রহণ শেষে নারীদের চাকরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধান করা একটা সময়ের দাবী ।

এই দেশে পড়াশুনা শেষ করে ভাল ক্যারিয়ার গড়তে গেলে মোটামুটি ৩০ বছর তো লাগেই ।  ৩০ বছরের আগে অধিকাংশ ছেলের বিয়ে করা না হলেও ২৫ এর আগেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় । সামাজিক প্রেক্ষাপটে ৩০ পেরিয়ে যাওয়া মেয়েকে আয়ুবুড়ো ধাঁচের ধরা হয়ে থাকে। তাই চেহারার লাবণ্য থাকতেই দ্রুত বিয়ে দেয়া হয় মেয়েদের। শিক্ষিত সমাজে মেয়েদের অনার্স বা মাস্টার্স চলাকালীন সময়ে বিয়ে হলেও কম শিক্ষিত সমাজে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় কৈশোরেই ।

শিক্ষা জীবনে ব্যাপক সফলতা পাওয়ার পর ক্যারিয়ার গঠনের দৌড়ে নারীরা পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে অনেকেই বিয়েকে দায়ী করেন । কারও কারও মতে, “Marriage is the speed breaker of life ” কিন্তু কথাটা আসলে কতটা সত্য? আপাত দৃষ্টিতে ‘বিয়ে’ নারী-পুরুষ উভয়ের ক্যারিয়ের গঠনের ক্ষেত্রে অন্তরায় মনে হলেও আসলে মূল সমস্যা অন্য জায়গায় । ক্যারিয়ার গড়ার জন্য বিয়েকে প্রতিবন্ধক ভাবা হয় আমাদের স্থূল বুদ্ধির কারণে । নারী পুরুষের দ্রুত বিয়ে হলে আমাদের সমাজে বরং নৈতিক ও চারিত্রিক অবক্ষয় কিছুটা কমবে ।

আরও পড়ুন-নারীর সত্যিকারের স্বাধীনতা আসে যেভাবে

বিয়ে নয় বরং বিয়ের পর নারীর উপর অর্পিত হওয়া দায়িত্ব ও কাজের চাপ নারীর ক্যারিয়ার গঠনে প্রতিবন্ধক। একজন বিবাহিত পুরুষের তুলনায় একজন বিবাহিত নারীর উপর সাংসারিক কাজের দায়িত্ব থাকে অনেক বেশি। শিক্ষিত সমাজে স্বামী চাকুরী বা ব্যবসা এবং বাসার বাজার করলেই তার কাজ যেন শেষ । অন্যদিকে স্ত্রীর কাজের শেষ নেই । সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত একজন বিবাহিত নারীকে অনবরত খেঁটে যেতে হয় । এ বেলার খাবার বানানো, ও বেলার  চা-নাস্তা তৈরি, থালা-বাটি মাজা, ঘর মোছা, ফার্নিচার মোছাসহ কত কাজ যে করতে হয় একটা মেয়েকে! আবার পড়া শেষ হতে না হতেই অনেকে মা হয়ে যায় । মা হবার কারণে সন্তানের জন্য তার দায়িত্ব এবং কাজের চাপ আরও বেড়ে যায় । সাংসারিক কাজের সাথে যোগ হয় সন্তানের জন্য খাবার তৈরি, সন্তানকে খাবার খাওয়ানো, তার সাথে খেলা করা, তাকে ঘুম পাড়ানো; সারাদিন পরিশ্রম করার পর রাতে আবার স্বামীকে সময় দেয়া, রোমান্টিক সময় কাটানো …। এগুলো সারতে সারতে বেচারা শিক্ষিত নারীর সেই অর্থে আর গতানুগতিক ধারার ক্যারিয়ার গড়ার সময় হাতে থাকে না। সন্তান জন্মের পর সন্তানের নিরাপত্তা, সংসারের দেখভালের কথা চিন্তা করে অনেকেই গৃহিণী বা হোম মেকারটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেয় । কেউ চাকুরী পেলেও তা কোনও মতে চালিয়ে নেয় । সেই পেশায় আরও ভাল করার চেষ্টা ছেড়ে দেয় ।

একবার ঢাকা মেডিকেলের প্রাক্তন ছাত্রী এবং শহিদ সোহরাওয়ার্দি মেডিকেলের একজন চিকিৎসকের সাথে কথা হচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, “আমি এবং আমার মেয়ে বান্ধবীরা এফসিপিএস এবং এমডি করার সুযোগই পাচ্ছি না । ক্লাসের ফার্স্ট বেঞ্চে বসা ভালো ছাত্রী হওয়ার পরও আমাদের সুযোগ হচ্ছে না সন্তান ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে । মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয় এবং মনে হয় এমন কঠিন পেশায় কেন এলাম?  মেডিকেলে না পড়ে যদি এমন কোন বিষয়ে পড়তাম যাতে সহজ পেশা বেছে নেয়া যায়, তাহলে কতোই না ভাল হতো । সংসার ও পেশা দুইটা একসাথে চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে । অথচ আমাদের ক্লাসের ব্যাক বেঞ্চার ছেলে বন্ধুরা সবাই এফসিপিএস এবং এমডি করে ফেলেছে । পেশায় তারা অনেক ভাল করছে ।”

হিলারি ক্লিনটন তার বিখ্যাত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ “লিভিং হিস্ট্রি”তে এক বিখ্যাত আইনজীবী বার্ট জেনার এর সাথে পুরুষের মতো নারীদের ক্যারিয়ার গড়তে না পারার সম্ভাবনা নিয়ে কথপোকথনের একটা অংশ তুলে ধরেন । “কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আমি কি করতে চাই । উত্তরে আমি বললাম, ‘আমি তার মতো বিখ্যাত ট্রায়াল আইনজীবী হতে চাই ।’ তিনি বললেন, ‘সেটা অসম্ভব ।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন?’ ‘কারণ তোমার তো বউ থাকবে না ।’‘তার মানে? ’ বার্ট আমাকে বুঝিয়ে বললেন যে, কারও ঘরে যদি বউ না থাকে যাবতীয় কাজ দেখাশুনা করার, তাহলে সেই ব্যক্তির পক্ষে প্রতিদিনকার চাহিদা (যেমন কোর্টে প্রতিদিন পরিষ্কার মোজা পরে যাওয়া) মেটানো সম্ভব নয় । সেই থেকে আমি এখনও নিশ্চিত নই বার্ট  জেনার আমাকে  তামাশা করে কথা বলেছিলেন নাকি সত্যি মনে করেই বলেছিলেন যে, মেয়েদের জন্য এটা একটা ভীষণ কঠিন কাজ । ”

তবে স্বামী ও পরিবারের সহায়তা পেলে আবার যে কোনও মেয়ে বেশ ভাল করতে পারে । বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার বিভাগের এক ছোট বোন ইফফাত সকাল ৩৭তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পর ফেসবুকে পোস্ট দেয় এই বলে, “অবশেষে গেজেট হলো । ফাইনালি চাকরিতে জয়েন করতে যাচ্ছি । আসলে চাকরি করতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই কিন্তু ওই যে পড়াশোনা করে চুপচাপ ঘরে বসে থাকবো এটা কেন যেন মেনে নিতে পারি না । অবশ্যই আমার এই পাওয়ার পেছনে আমার ফ্যামিলির সবার অবদান ছিল। কারণ দুইটা বাচ্চা নিয়ে পড়ালেখা করা এতটা সহজ কিছু না । মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি, বোন সবাই সহযোগিতা করেছে । কিন্তু তারা একবার হলেও কখনও কখনও বলেছে দরকার কি বাদ দিয়ে দাও। আর হবে না । যে একটা মানুষ কখনও কোন অবস্থাতে আমাকে বলে নাই যে আমি পারব না, সেটা আমার হাজব্যান্ড। কারণ সে জানতো আমি কিছু না করে ঘরে বসে থাকলে মানসিকভাবে কতটা কষ্ট পাবো । এই মানুষটি সব সময় বলেছে অবশ্যই হবে। তুমি চেষ্টা করলেই পারবে । আমি পড়েছি, সে বেবিকে ঘুম পাড়িয়েছে । আমার জন্য রাত জেগেছে। কখনো বলেনি এটা করো, ওটা করো। বিয়ের পর হাজবেন্ডের সাহায্য ছাড়া আসলে যেকোনো কিছু করাই কঠিন।। সেটা যাই হোক । এই মানুষটা সব সময় আমাকে সব কিছুতে সাপোর্ট করে গিয়েছে…।”

আরও পড়ুন-পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কুৎসিত মা

চাকুরীতে নারীদের পিছিয়ে থাকার আরও একটা বড় কারণ হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব । রাস্তা ঘাটে,অফিসে পুরুষদের নানা ধরণের যৌন হয়রানি মূলক ইঙ্গিত ও আচরণের কারণেও অনেক নারী চাকুরীর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে । এছাড়াও অফিসে নানা ধরণের লিঙ্গ বৈষম্য তো আছেই।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে মহিলাদের ভূমিকা

তবে মেয়েদের জন্য ক্যারিয়ার বলতে শুধু অর্থ উপার্জনের মাধ্যম একটা চাকুরী বা ব্যবসাকে বলা ঠিক হবে না । একটা ছেলের মতো একটা মেয়েকেও ক্যারিয়ার গড়ার জন্য চাকুরী বা ব্যবসা করতেই হবে এমন ধারণা থেকে আমাদের বের হওয়া উচিৎ । কেউ যদি  “মাতৃত্ব”কে তার পেশা বা ক্যারিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেন তাহলে সেখান থেকে অর্থ উপার্জন হয় না বলে তাকে অসফল নারী বলার কোনও সুযোগ নেই । বরং তিনি পরিবার, সমাজ এবং একটা জাতির জন্য সবচেয়ে লাভজনক পেশায় নিয়োজিত আছেন  । যিনি মাতৃত্বকে অগ্রাধিকার দিয়ে গৃহিণী বা হোম মেকার হওয়াটা নিজের জীবনের পেশা বা ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন অর্থ উপার্জনের ভিত্তিতে তথাকথিত ক্যারিয়ারের মানদণ্ডে তাকে ছোট করে দেখার কোনও সুযোগ নেই । তাকে সম্মান দিতে শিখলে এ সমাজেরই লাভ হবে । স্বামীর মতো মাসিক বেতন হিসেবে হাজার হাজার টাকা  সংসারের জন্য ব্যয় করতে না পারলেও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যে, নারীর সামাজিক ও পারিবারিক কল্যাণমূলক শ্রমের মূল্য সঠিকভাবে নির্ধারণ করলে ও কর্মপরিবেশ সুস্থ হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশে, যা মোট জাতীয় উন্নয়নের প্রায় অর্ধেক বলা যায় ! অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক গ্যারি বেকের কাতারের দোহায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে একটি বক্তব্য দেন। সেই বক্তব্যে তিনি বলেন, “বাচ্চাদের যত্ন ও প্রতিপালনের জন্য যে সকল নারী ঘরে থাকেন, তারা জাতীয় অর্থনীতিতে ২৫ % থেকে ৫০% হারে অংশগ্রহণ করেন । অথচ এই তথ্য অনেকেই জানে না । অনেকে মনে করে, যে সকল নারী ঘরের দায়িত্ব পালন করেন; তারা বেকার । তাদের দৃষ্টিতে, নারীগণ জাতীয় উৎপাদনের বোঝাস্বরূপ । অথচ আমরা দেখছি আন্তর্জাতিক অর্থনীতি তার বিপরীত সাক্ষ্য দিচ্ছে ।” [সূত্রঃ  বইঃ মুমিন জীবনে পরিবার, লেখকঃ ইউসুফ আল কারজাভি ]

অবশেষে বলতে চাই যে, পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে ও ক্যারিয়ার গড়তে নারীর চাওয়া পাওয়ার মূল্যায়ন করা হোক, তাকে সহায়তা দেয়া হোক । সংসারের কাজ ভাগাভাগি করে তার উপর কাজের বোঝা কমানো হোক । নারীর কাজকে ছোট করে দেখার এবং তাকে ছোট করে রাখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাক । ‘মাতৃত্ব’ বা নারীর জন্য নিরাপদ অন্য যে কোনও পেশা যদি কোনও নারী বেছে নেয় পরিবারের সমঝোতার ভিত্তিতে তাহলে সেটা সাদরে গ্রহণ করা হোক। নারী বিয়ে এড়িয়ে নয় বরং বিয়ের পর স্বামী ও পরিবারের সহায়তায় এগিয়ে যাক তার স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে এই প্রত্যাশা করি সব সময় ।

লেখকঃ লেখক ও সম্পাদক, মহীয়সী (www.mohioshi.com

লেখাটি প্রথম আলোতে পূর্ব প্রকাশিত ।  প্রথম আলোর লিংক-চাকুরির বাজারে পুরুষের চেয়ে নারীরা পিছিয়ে কেন ?

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প  ও কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

ফেসবুকে লেখক শারমিন আকতার

আরও পড়ুন