Ads

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কুৎসিত মা

।। আমিনা তাবাস্সুম ।।

আমি একজন মায়ের গল্প করতে চাই। যেই মা তার সন্তানদের জন্য পৃথিবীর কুৎসিততম মহিলার উপাধি বরণ করে নিয়েছিলেন। ম্যারি অ্যান বেভান (Mary Ann Bevan) তার নাম। জন্ম ১৮৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে লন্ডন শহরে। সাত ভাই চম্পার একমাত্র বোন ছিলেন তিনি। যদিও আট ভাইবোনের পরিবারের একটা মেয়ের জন্য সেসময় পড়াশুনা করা সহজ ব্যাপার ছিলোনা, তাও ম্যারি অ্যান নার্সিংয়ের উপর লেখাপড়া শেষ করে নার্সিংকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।

সুন্দরী, শিক্ষিত, কর্মজীবি ম্যারি অ্যানের বিয়ে একটু দেরিতেই হয়। ২৯ বছর বয়সে ম্যারি অ্যান বিয়ে করেন টমাস বেভান (Thomas Bevan) নামের এক ভদ্রলোককে। চার সন্তান নিয়ে তাদের সুখের সংসার ছিল বলা যায়। কিন্তু নশ্বর এই পৃথিবীর মতো ম্যারি অ্যানের জীবনের সবকিছুই যেন নশ্বর, সব কিছুই যেন ক্ষণস্থায়ী – রূপ, পেশা, স্বামী সব। বিয়ের মাত্র তিন বছরের মাথায় ম্যারি অ্যানের অ্যাক্রোমেগালি (acromegaly) নামের একধরণের বিরল অসুখ হয়। সেই সময় এই অসুখ সম্পর্কে ডাক্তারদের তেমন কোনো ধারণাই ছিলোনা। ভীষণ অদ্ভুত এই রোগ। এই অসুখে মাথার পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে অতিরিক্ত হরমোন নিঃসরণ হয়। আর অতিরিক্ত হরমোনের কারণে শরীরের বিভিন্ন অংশের গ্রোথ বেড়ে যায়। বিশেষ করে হাত পা অতিরিক্ত লম্বা হয়ে যেতে থাকে। ম্যারি অ্যানের ক্ষেত্রে ওর মাথার খুলি এবং মুখের হাড়ও অত্যাধিকভাবে বেড়ে যায়। যা সুন্দর মুখের ম্যারিকে ধীরে ধীরে এক কুৎসিত রমণীতে রূপান্তরিত করে তুলে।

এই যুগেও বাহ্যিক সৌন্দর্য একজন ব্যক্তির জীবনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে থাকে। আর সেই যুগে তো এইসবের ব্যাপারে কোনো রাখ ঢাকই ছিলোনা। এই বিরল অসুখে ম্যারি অ্যানের জীবনের মোড় ঘুরে যায়, সবার কাছে ধীরে ধীরে তিনি হতকুৎসিত হিসেবে নতুন পরিচয় লাভ করেন। কিন্তু ম্যারি অ্যানের এই পরিবর্তন তাদের সংসার জীবনে নাকি তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। তার স্বামী টমাস কিন্তু সবসময়ই স্ত্রীর পাশে ছিলেন।

কিন্তু ওই যে বলেছিনা, নশ্বর এ পৃথিবীতে কিছুই বেশিদিন টেকেনা। তাদের সংসারও বেশিদিন টেকেনি। বিয়ের এগারো বছরের মাথায় ম্যারি অ্যানের স্বামী হৃদ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে হঠাৎ করেই মারা যান। ইতিমধ্যে ম্যারি অ্যান তার নার্সের চাকরিও হারান। লোকে বলে তার ভয়ঙ্কর চেহারার কারণেই তাকে চাকরী চুত্য করা হয়। আর এই চেহারা নিয়ে তার নতুন কোনো চাকরি পাবারও কোনো সম্ভাবনা ছিলোনা। এছাড়া অসুখের কারণে ম্যারি অ্যানের শরীরও ভীষণ খারাপ থাকতো। সব মিলিয়ে চার সন্তানের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করতে গিয়ে ম্যারি অ্যান ঋণের সাগরে নিমিজ্জিত হতে থাকে। কোনোভাবেই এর থেকে মুক্তির কোনো উপায় ম্যারি অ্যান খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

অবশেষে সন্তানদের মানুষ করার তাগিদে, ঋণ মুক্ত হবার আশায় ম্যারি অ্যান বিশ্বের সবচেয়ে কুশ্রী মহিলার (the ugliest woman in the world) প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। শুধু তাই না সেই প্রতিযোগিতায় তিনি শিরোপাও জিতে নেন। আর পুরস্কার স্বরূপ যেই অর্থ পান তা দিয়ে শুধুমাত্র ঋণমুক্তই হন না, কিছুদিনের জন্য ছেলেমেয়েদের ভরণ পোষণের খরচও উঠে আসে।

ম্যারি অ্যানের এই নতুন পরিচিতি স্বাভাবিকভাবেই মিডিয়া জগতেও ব্যাপক সাড়া তুলে। টাকার বিনিময়ে ম্যারি অ্যানের ছবি তুলে সেই চেহারা নিয়ে ভয়ঙ্কর সব গল্প প্রকাশিত হতে থাকে। ম্যারি অ্যান সব মাথা পেতে নেন। তার সন্তানরা তো এতে করে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারছে। কারও কাছে হাত পাততে তো হচ্ছেনা। এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে?

মিডিয়ার এই প্রচার ম্যারি অ্যানের জীবনে অন্য আরেক দুয়ার খুলে দেয়। ১৯২০ সালে জনপ্রিয় আমেরিকার কনি আইল্যান্ডের ড্রিমল্যান্ড সার্কাসে ম্যারি অ্যান কাজের অফার পায়। ড্রিমল্যান্ড সার্কাস ফ্রিকদের (freak) প্রদর্শন করার জন্য সেসময় ভীষণ জনপ্রিয়। খুঁজে খুঁজে সমাজের চোখে কুৎসিত, কদাকার, উদ্ভট মানুষদের কুৎসিততম, কদাকারতম, উদ্ভটতম সাজিয়ে জনসম্মুখে প্রদর্শন করা হতো। আর ভাগ্যবান সব “স্বাভাবিক, সুন্দর, সাধারণ” মানুষরা তাদের দেখে চিৎকার করে, তিরস্কার আর লাঞ্ছনা করে, মাতম করে পাশবিক আনন্দ পেতো। সার্কাস কোম্পানি দুহাত ভরে অর্থ কামাতো আর দুর্ভাগা কিছু মানুষের ভাগ্যে জুটতো খেয়ে পরে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা।

হ্যাঁ, নিজেকে কুৎসিত ভাবে প্রদর্শন আর অপমান, লাঞ্ছনা এবং তিরস্কার কামানোর মধ্যেই ছিল ম্যারি অ্যানের সার্থকতা এবং সফলতা। সেই সার্কাসে যোগদান করেই ম্যারি অ্যান আমেরিকা ট্যুরে যান। আর তার প্রথম ট্যুরের সাফল্যই ছিল আকাশচুম্বী। নিউ ইয়র্কের প্রায় সব পত্রিকার কাভার পেইজে “The Ugliest Woman on Earth” শিরোনামে জায়গা করে নেন তিনি। প্রথম দুই বছরের আমেরিকা আর ইউরোপ সার্কাস ট্যুরগুলো থেকে যা অর্থ আয় করেন তা দিয়ে ম্যারি অ্যান চার সন্তানকে ভীষণ ভালো বোর্ডিং স্কুলে রেখে তাদের পড়াশুনা আর দেখভালের ব্যবস্থা করে ফেলেন।

ম্যারি অ্যান নাকি ছেলেমেয়েদের ভীষণ মিস করতেন। বিভিন্ন দেশের ট্যুর থেকে নিয়মিত সন্তানদের চিঠি লিখতেন তিনি। ছেলেয়েরা যে ভালো আছে, তারা যে ভালো একটা জীবন তৈরি করতে পারছে, এটাই ছিল তার জীবনের এক বড় পরিতৃপ্তি। ৫৯ বছর বয়সে ম্যারি অ্যানের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। আর মারা যাবার আগ পর্যন্ত তিনি কনি আইল্যান্ড ড্রিমল্যান্ড সার্কাসের সাথেই ছিলেন। ম্যারি অ্যানকে তার জন্মশহর লন্ডনেই দাফন করা হয়।

তবে মৃত্যুর পরও শেষ হয়ে যায়নি ম্যারি অ্যানের কাহিনী। অনেকেই তার ছবিগুলো ব্যবহারের সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি। এমনকি একবিংশ শতাব্দীতে এসে হলমার্কের মতো নামকরা কার্ড কোম্পানি ম্যারি অ্যানের ছবির সদ্ব্যবহার করেছে । হলমার্কের “ব্লাইন্ড ডেট” সংক্রান্ত এক জনপ্রিয় বার্থডে কার্ডে বহাল তবিয়তে জায়গা করে নেয় ম্যারি অ্যানের চেহারা। কার্ডটা ছিল এরকম – ব্লাইন্ড ডেটের এক্সপেক্টেশন vs রিয়েলিটি। এক্সপেক্টেশনের নিচে এক আকর্ষণীয় লাস্যময়ী রমণীর ছবি আর রিয়েলিটির নিচে ম্যারি অ্যানের ছবি। কী দারুণ মজার কনসেপ্ট না? তবে যদি রোগাক্রান্ত ম্যারি অ্যানের সেই “কদা-কুৎসিত” চেহারার ভিতরকার তার আসল রূপ, তার মাতৃরূপ দেখা যেত, তাহলে সেই কার্ড দেখে আর কারো মজা লাগতোনা। লজ্জা, কুন্ঠা, অপরাধবোধ আর সাথে সাথে সেই মানুষটার প্রতি সম্মানে সবার মাথা হেঁট হয়ে যেত।

বি:দ্র: হলমার্ক কার্ডটি নিয়ে পরবর্তীতে এক ডাচ ডক্টর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এরপর হলমার্ক ক্ষমা চেয়ে সেই কার্ডের প্রচার বন্ধ করে দেয়।

ছবি এবং তথ্যসূত্র ইন্টারনেট

আরও পড়ুন-ভ্রমণকাহিনীঃ সূর্যস্নাত বেন নেভিস

আরও পড়ুন