Ads

প্রতিদিনের কাজগুলো যেভাবে সাদাকায়ে জারিয়া হবে

।। ড. মোহাঃ ইয়ামিন হোসেন ।।

সাদাকায়ে জারিয়া এমন এক ধরনের দান যা থেকে দানকারী দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পরও উপকৃত হয় এবং এর সাওয়াব অব্যাহত থাকে। কুরআন ও হাদিসের আলোকে সাদাকায়ে জারিয়ার বিভিন্ন কাজ সম্পর্কে জানলে, আমরা এই পুণ্যের ধারা বজায় রাখতে পারি।

সাদাকায়ে জারিয়ার গুরুত্ব

আল-কুরআনে আল্লাহ বলেন,”যারা নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে রাত ও দিন, গোপনে ও প্রকাশ্যে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে পুরস্কার রয়েছে। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না।” (সুরা আল-বাকারাহ, ২:২৭৪)

হাদিসেও সাদাকায়ে জারিয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে,

“যখন কোনো ব্যক্তি মারা যায়, তখন তার সব কাজের ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়ে যায়, তবে তিনটি কাজের ধারাবাহিকতা বন্ধ হয় না: সাদাকায়ে জারিয়া, এমন জ্ঞান যা থেকে মানুষ উপকৃত হয়, এবং এমন নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।” (মুসলিম ১৬৩১)

সাদাকায়ে জারিয়ার বিভিন্ন প্রকার

সাদাকায়ে জারিয়ার বিভিন্ন রূপ হতে পারে। আমাদের সাধ্যের মধ্যে থেকে প্রতিদিন কিছু কিছু কাজ করা উচিত যেগুলো সাদাকায়ে জারিয়া হিসেবে মহান আল্লাহ কবুল দয়া করে যেন কবুল করেন। আসুন সাদাকায়ে জারিয়া হিসেবে দুনিয়ায় থেকে যাওয়া কাজগুলো জেনে তা করার চেষ্টা করি। নিম্নে কিছু সাধারণ রূপ উল্লেখ করা হলো:

১। জ্ঞান বিতরণ করা

জ্ঞান বিতরণের মাধ্যমে মানুষকে আলোকিত করা সাদাকায়ে জারিয়ার একটি প্রধান উদাহরণ।

আল কোরআনে বলা হয়েছে,”যে ব্যক্তি জ্ঞান দান করে, সে যেন সোনার খনি প্রদান করে।” – (সুরা মুজাদিলা, আয়াত ১১)

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন:“যে ব্যক্তি এমন জ্ঞান প্রদান করে যা মানুষকে উপকারে আসে, সে মরে গেলেও তার জন্য সওয়াব অব্যাহত থাকবে।” – (সহীহ মুসলিম)

জ্ঞান বিতরণের কিছু উপায়:

®  বই, কুরআন, হাদিস বা ইসলামী সাহিত্য দান করা।

®  স্কুল, মাদ্রাসা বা লাইব্রেরি স্থাপন করা।

®  ইন্টারনেটে ইসলামিক কন্টেন্ট শেয়ার করা।

® শিশুদের এবং অশিক্ষিতদের কুরআন শেখানো।

® ধর্মীয় জ্ঞানবৃদ্ধি সম্পর্কিত বই, পুস্তক বা অনলাইন কন্টেন্ট তৈরি করা।

® ইসলামের মৌলিক জ্ঞান নিয়ে অনলাইন ক্লাস বা লেকচার প্রদান করা।

আরও পড়ুন-কেন বই পড়া উচিত

২। পানি সরবরাহ করা

পানি মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলির একটি এবং পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা একটি বড় সাদাকায়ে জারিয়া। আল্লাহ বলেন, “আমরা পানি দিয়েছি তাদের জন্য পানীয় ও তাদের পশুর জন্য এবং তাদের জমির সেচের জন্য।” – (সুরা হিজর, আয়াত ২২)। হাদিসে আছে, “সবচেয়ে ভালো দান হলো পানি প্রদান করা।” (আবু দাউদ ১৬৭৬) । হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি পানি সরবরাহ করে, সে যেন জান্নাতে প্রবেশের পথ খুলে দেয়।” – (সহীহ বুখারী)

হাদিসে আরো আছে, “যে ব্যক্তি মুমিনদের জন্য একটি কূপ খনন করে, তার জন্য জান্নাতে একটি ফলের বাগান আছে।” (তিরমিযী)

পানির সরবরাহ নিশ্চিত করার উপায়:

® কূপ খনন করা।

®  মসজিদ বা জনসমাগমস্থলে পানির ফিল্টার বা কুলার স্থাপন করা।

® জনসাধারণের জন্য ফ্রি টিউবওয়েল স্থাপন করা।

® রাস্তার পাশে পানি পান করার সুবিধা দেওয়া।

® গরীব এলাকায় পানি পরিশোধন প্রকল্প স্থাপন করা।

৩। গাছ রোপণ করা

গাছ রোপণের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ করা এবং মানুষ ও পশুপাখিদের উপকৃত করা সম্ভব। আল্লাহ বলেন, “আমি পৃথিবীতে গাছপালা জন্মাই যাতে তোমরা খাদ্য পেতে পার।” – (সুরা ইয়াসিন, আয়াত ৩৩)

নবী করীম (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি একটি গাছ রোপণ করে এবং তা থেকে কোনো মানুষ বা প্রাণী ফল খায়, এটি তার জন্য সাদাকায়ে জারিয়া।” (মুসলিম)

গাছ রোপণের উপায়:

® ফলদায়ক গাছ রোপণ করা।

®  সড়কের ধারে, পার্কে বা জনসমাগমস্থলে গাছ লাগানো।

® বিদ্যালয়ে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের গাছ লাগানোর জন্য উৎসাহিত করা।

আরও পড়ুন-নামাজের পাঁচওয়াক্ত-পাঁচসময় কেন?

৪। মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ

মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণের মাধ্যমে মানুষকে ইবাদত ও শিক্ষার সুযোগ প্রদান করা।আল্লাহ বলেন, “যারা আল্লাহর ঘর নির্মাণ করে ও তা সংরক্ষণ করে, তারা পরকালে পুরস্কৃত হবে।” – (সুরা তওবা, আয়াত ১৮) । আল্লাহ আরো বলেন, “যারা আল্লাহর ঘর নির্মাণ করে ও তা সংরক্ষণ করে, তারা পরকালে পুরস্কৃত হবে।” – (সুরা তওবা, আয়াত ১৮) । হাদিসে বর্ণিত আছে,”যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ একটি ঘর নির্মাণ করেন।” (বুখারী)

মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণের উপায়:

® মসজিদ নির্মাণে অর্থ দান করা।

®  মাদ্রাসার জন্য জমি বা অর্থ দান করা।

® মসজিদের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম যেমন কুরআন, জায়নামাজ ইত্যাদি প্রদান করা।

৫। সড়ক, ব্রিজ ও পাবলিক সুবিধা স্থাপন

সড়ক ও ব্রিজ নির্মাণের মাধ্যমে মানুষের যাতায়াতের সুবিধা প্রদান করা একটি বড় সাদাকায়ে জারিয়া। হাদিসে এসেছে, “একজন মুমিনের যে কোনো ভালো কাজ যা তার মৃত্যুর পরও মানুষের উপকারে আসে, যেমন পানির উৎস তৈরি করা, সড়ক নির্মাণ করা ইত্যাদি সাদাকায়ে জারিয়া হিসেবে গণ্য হয়।” (মুসলিম)

পাবলিক সুবিধা স্থাপনের উপায়:

® সড়ক নির্মাণে অর্থায়ন করা।

® পাবলিক টয়লেট বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ করা।

আরও পড়ুন-‘ইনশাল্লাহ’ কেন বলতে হয়?

৬। এতিম ও দুঃস্থদের সাহায্য

এতিম ও দুঃস্থদের সাহায্য করা একটি মহৎ কাজ এবং এটি সাদাকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত। কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “এবং তারা আল্লাহর ভালোবাসায় দরিদ্র, এতিম ও বন্দীদেরকে আহার করায়।” (আদ-দাহর ৭৬:৮)

এতিম ও দুঃস্থদের সাহায্যের উপায়:

® এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করা।

® দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি প্রদান করা।

৭।  শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন

শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার এবং ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরজ।” (ইবনে মাজাহ)

শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উপায়:

®  স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা।

® বৃত্তি প্রদান করা এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা করা।

৮।  স্বাস্থ্যসেবা প্রদান

স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মাধ্যমে মানুষকে সুস্থ থাকার সুযোগ করে দেওয়া। আল্লাহ বলেন:”এবং যারা তোমাদের মধ্যে দুর্বল, অসুস্থ ও গরিবদের প্রতি সেবা করে, তাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে।” – (সুরা নূর, আয়াত ৩২) ।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন,”যে ব্যক্তি অসুস্থকে সেবা করে, সে যেন আল্লাহর পথে কাজ করে।” – (সহীহ বুখারী) ।

হাদিসে আরো উল্লেখ আছে, “যে ব্যক্তি একজন অসুস্থকে সেবা করে, সে যেন আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছে।” (তিরমিযী)

স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের উপায়:

®  হাসপাতাল বা ক্লিনিক স্থাপন করা।

®  ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প আয়োজন করা।

® ভালো একজন ডাক্তারের খোঁজ বা ঠিকানা জানানো, সাথে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া বা রোগীর সিরিয়াল করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।

আরও পড়ুন-যে কারণে জুমআর দিন সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করা হয়

৯। ভালো অভ্যাস ও আখলাক শেখানো

ভালো অভ্যাস ও আখলাক শেখানোর মাধ্যমে সমাজকে সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ করা। নবী করীম (সা.) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই উত্তম যার আখলাক উত্তম।” (বুখারী)

কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন,”এবং তাদের মধ্যে এমন এক দল থাকা উচিত যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎ কাজের নির্দেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে।” (আল ইমরান ৩:১০৪) ।

ভালো অভ্যাস ও আখলাক শেখানোর উপায়:

® শিক্ষামূলক সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন।

®  বিভিন্ন মিডিয়ায় ভালো আখলাক সম্পর্কে প্রচার করা।

১০। অনলাইন কন্টেন্ট তৈরি ও শেয়ার করা

আধুনিক যুগে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সাদাকায়ে জারিয়া করা সহজ হয়েছে। নবী করীম (সা.) বলেছেন,”যে ব্যক্তি সৎ কাজের দিকনির্দেশনা দেয়, তার জন্য তা করণকারীর সমতুল্য সাওয়াব রয়েছে।” (মুসলিম)

অনলাইন কন্টেন্ট তৈরির উপায়:

® ইসলামিক ব্লগ, ওয়েবসাইট বা ইউটিউব চ্যানেল চালানো।

® সামাজিক মাধ্যমে কুরআন ও হাদিসের বার্তা প্রচার করা।

১১। দরিদ্রদের সহায়তা

আল্লাহ বলেন,”তোমরা দরিদ্রদের সহায়তা কর এবং তাদের মধ্যে যারা অভাবগ্রস্ত তাদের সহযোগিতা কর।” – (সুরা বাকারাহ, আয়াত ২৭৪) । হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন,”দরিদ্রকে দান করা উত্তম, তবে আত্মীয়স্বজনকে দান করা দ্বিগুণ পুরস্কৃত হয়।” – (সহীহ মুসলিম)

প্রতিদিনের কাজ:

® গরিবদের খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান প্রদান করা।

® ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধের জন্য সাহায্য করা।

® বিভিন্ন সাহায্য সংস্থায় দান করা।

আরও পড়ুন-রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট করবেন যেভাবে ।। পর্ব -১

১২। সাদাকাহ বা দান

প্রতিদিন কিছু না কিছু দান করা। দান ছোট হোক বা বড়, তা সাদাকায়ে জারিয়া হতে পারে যদি তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়। আল-কুরআনে আছে,”তোমরা উত্তম বস্তু থেকে দান করো যা তোমরা উপার্জন করো।” (সুরা বাকারা, ২:২৬৭)

১৩। দুআ করা

নেক সন্তানদের জন্য দুআ করা এবং তাদেরকে নেক কাজ শেখানো। সন্তানদের সঠিক পথে পরিচালিত করলে তারা পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক পথে চালিত করবে।

১৪। ভালো শিক্ষা প্রদান

সন্তানদের এবং অন্যদের সঠিক ও ভালো শিক্ষা প্রদান করা। হাদিসে বলা হয়েছে,”যে ব্যক্তি এমন জ্ঞান রেখে যায় যা থেকে মানুষ উপকৃত হয়, তার মৃত্যুর পরও তার সওয়াব চলতে থাকে।” (মুসলিম ১৬৩১)

উপসংহার

সাদাকায়ে জারিয়া এমন এক প্রকার দান যা মানুষের মৃত্যুর পরেও চলতে থাকে এবং এর সাওয়াব অব্যাহত থাকে। কুরআন ও হাদিসের আলোকে এই বিভিন্ন কার্যাবলী পালনের মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনে এবং পরকালে পুণ্যের ধারা বজায় রাখতে পারি। আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী এই ধরনের কার্যকলাপের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করতে পারি। মহান আল্লাহ আমাদেরকে বেশী বেশী সাদাকায়ে জারিয়ার কাজগুলো করার তৌফিক দান করুন। আমিন ইয়া রব্বুল আলামীন!

লেখকঃ প্রাবন্ধিক এবং অধ্যাপক, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় 

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প  ও কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

ফেসবুকে লেখক  মোঃ ইয়ামিন হোসেন 

আরও পড়ুন