Ads

যে কারণে জুমআর দিন সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করা হয়

।। জামান শামস ।।

জুমআর দিন সাধারণত সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করে থাকেন অনেকেই । জুমআর দিন সূরা কাহাফ পড়ার বিষয়ে হাদীসে বেশ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। নিচে এই সম্পর্কে কিছু হাদিস তুলে ধরা হল-

১। আবু সাঈদ আল-খুদরি (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: “যে ব্যক্তি জুমার রাতে সূরা কাহাফ পড়বে এটি তার জন্য তার মাঝে ও আল-বাইতুল আতীকের মধ্যবর্তী (স্থান) আলোকিত করে দিবে।”[এই উক্তিটিকে আলবানী ‘সহিহুল জামে’ গ্রন্থে (৬৪৭১) সহিহ বলেছেন]

২। “যে ব্যক্তি জুমার দিন সূরা কাহাফ পড়বে এটি তার জন্য দুই জুমার মধ্যবর্তী (সময়) নূরে আলোকিত করে দিবে।”[মুসতাদরাকে হাকেম (২/৩৯৯) ও বাইহাকী (৩/২৪৯)] ইবনে হাজার ‘তাখরিজুল আযকার’ গ্রন্থে বলেন: হাসান হাদিস। তিনি আরও বলেন: সূরা কাহাফ পড়ার ব্যাপারে বর্ণিত হাদিসগুলোর মধ্যে এটি সর্বাধিক শক্তিশালী। দেখুন: ফাইযুল ক্বাদির (৬/১৯৮), আলবানী সহিহুল জামে গ্রন্থে (৬৪৭০) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।

৩। ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি জুমার দিন সূরা কাহাফ পড়বে তার জন্য তার পায়ের নীচ থেকে আসমানের মেঘমালা পর্যন্ত একটি আলো বিচ্ছুরিত হবে এবং দুই জুমার মধ্যবর্তী তার যা (গুনাহ) আছে সেটা থেকে তাকে মাফ করে দেয়া হবে।” [আত-তারগীব ওয়াত তারহীব (১/২৯৮)]

সুরা কাহফ-এ চারটি ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে যা অনেক শিক্ষনীয়। ঘটনাগুলো হচ্ছে-

ক) ঈমান আনা ও সৎ পথে থাকার কারণে সমাজের মানুষের নির্যাতন থেকে বাঁচতে কয়েকজন যুবক এক পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেন। তাদেরকে আল্লাহ তিনশত নয় বছর (বা তিনশত সৌর বছর) ঘুম পাড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখেন কোন খাদ্য ও পানীয় ছাড়া। সাথে তাদের কুকুরও ছিল। কুকুরটি গুহার মুখে এমনভাবে ছিল যাতে লোকে গুহার ভিতরে উকি দিতেও ভয় পেত।

তিনশত নয় বছর পরে আল্লাহ তাদের ঘুম ভাঙিয়ে দেন। তারা নিজেদের একজনকে বাজারে পাঠালেন খাদ্য কিনে আনার জন্য। সেখানে গিয়ে তিনি বুঝলেন, কয়েক শতাব্দী পার হয়ে গেছে। লোকজনের পোশাক তাদের থেকে ভিন্ন, তাদের কাছে থাকা কয়েন এখন বহু পুরানো আমলের। সবচেয়ে বড় কথা, যে ধর্ম গ্রহণের কারণে তারা হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন, সেই ধর্ম তখন বিজয়ী হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন- ‘ইনশাল্লাহ’ কেন বলতে হয়?

এখানেই এসে আমি চমকে উঠি। মনে প্রশ্ন জাগে, কেন আল্লাহ তিনশত নয় বছর ধরে এই ঈমানদার যুবকদেরকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে আবার জাগিয়ে তুললেন আর কেনই বা সেই ঘটনা আল কুরআনে সবিস্তারে বর্ণনা করলেন? কারণ, আল্লাহ তাঁর প্রিয় এই বান্দাদেরকে দেখাতে চেয়েছিলেন, দীনে হক বা সত্যের পথে থাকার জন্য যে যুলুম-নির্যাতনের শিকার তাদের হতে হয়েছিল, কয়েক শতাব্দী লাগলেও সেই দীন এক সময় বিজয়ী হয়েছে। আল্লাহ বিশ্বাসীদেরকে জানিয়েছেন, বর্তমানের সকল প্রতিকুলতা অগ্রাহ্য করে বিশ্বাস ও সৎকর্মে অটল থাকলে তার সুফল আল্লাহ দিবেন, কয়েক শতাব্দী পরে হলেও।

এরপর যুবকদেরকে আল্লাহ মৃত্যু দান করে তার কাছে নিয়ে যান।

তাফসীরকারকগণের মতে এই ঘটনা ঘটেছিল ঈসা (আ.) এর অনুসারীদের উপর। তাঁরা প্রচন্ড নির্যাতন ও ব্যাপক গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন। তারপর ঈসা (আ.) এর তিনশ বছর পর গণহত্যার অন্যতম নায়ক স্বয়ং রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন ঈসা (আ.) এর প্রচারিত ধর্ম গ্রহণ করেন এবং এর প্রধান পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন (যদিও এই ধর্ম তখন ঈসা (আ.) এর প্রচারিত ধর্ম থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল)।

এই ঘটনায় আল্লাহ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন, আজকে যে পৃথিবীকে আমরা দেখছি, এই পৃথিবী চিরকাল এমন থাকবে না। সত্য ও ন্যায় যেভাবে নির্যাতন ও অপমানের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, চিরদিন সেভাবেও যাবে না। হক জমিনে একদিন কায়েম হবেই তবে তা ঈমানদারদের কুরবানীর পরীক্ষার পর।

এ ধরণের আশা জাগানিয়া বহু ঘটনার মাধ্যমে আল-কুরআন চরম প্রতিকুলতার মধ্যেও সত্যের প্রতি নিষ্ঠাবান মানুষদের মনোবল অটুট রাখে, প্রতিরোধ সংগ্রামকে জারি রাখে। বিশ্বাসীদেরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলেও তারা এক সময় অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

খ) দ্বিতীয় ঘটনা একজন অহংকারী ধনাঢ্য ব্যক্তি সম্পর্কে। তার দুটো বিশাল বাগান ছিল। সে তার দুর্বল ও দরিদ্র বন্ধুকে গর্বভরে বলেছিল, ‘আমি তোমার থেকে অনেক বড় সম্পদ, কর্মচারি ও সন্তানে।’ আল্লাহ তার এই অহংকার পছন্দ করেননি এবং তার বাগান দুটো ধ্বংস করে দেন।

এই ঘটনাতেও আল্লাহ সমাজের দুর্বল ও সত্যপন্থী মানুষদেরকে জানাচ্ছেন, শক্তি ও সম্পদের অহংকারে যারা সীমা লঙ্ঘন করে আল্লাহ তাদেরকে পছন্দ করেন না এবং তাদের সম্পদ ও ক্ষমতা মুহুর্তেই ধ্বংস করে দিতে পারেন।এটাও সত্য যে দাম্ভিক ও অহংকারীরা না জমিন দাবিয়ে দিতে পারবে আর না আকাশ সীমায় উঠতে পারবে।

অহংকারী হয়ে আল্লাহর নিয়ামতের কথা ভুলে যাওয়ায় আল্লাহ তাঁর বাগানগুলো ধ্বংস করে দিলেন। ঘটনাটি তাদের জন্য, যারা দুনিয়ার মোহে আল্লাহর নিয়ামতের কথা ভুলে যায়। তারা ভুলে যায় আল্লাহ ইচ্ছা করলেই তাদের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিতে পারেন।

আরও পড়ুন- অন্যকে গড়ে তুলতে ভালো মন ও হৃদয় লাগে

গ) মুসা (আ.) ও খিদর (আ.) – এর ঘটনা: এতেও আল্লাহ জানাচ্ছেন, সাধারণ বুদ্ধিতে ও বর্তমানের প্রেক্ষাপটে আমরা যা ভাবি, দীর্ঘমেয়াদে বিষয়টি পুরো ভিন্ন রকম হতে পারে। বর্তমানের নিরিখে যা ক্ষতিকর, দীর্ঘ মেয়াদে তা কল্যাণকর হতে পারে। এখানে খিদির আ. কোন নবী ছিলেন না তবে তিনি আল্লাহর পসন্দনীয় বান্দা ছিলেন। মুসা আ. তার কাছ থেকে ইলম হাসিলের ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি তাকে এক সফরে সংগী হতে প্রস্তাব দেন তবে সতর্ক করেন যে পথে যেসব ঘটনা ঘটবে তাতে তৎক্ষনাৎ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ধৈর্যধারণ করতে। পথিমধ্যে তিনটি বড় ঘটনা ঘটে-দরিদ্র মাঝিদের নৌকা ছিদ্র করে দেয়া, একটি আপাত নিরপরাধ শিশুকে হত্যা ও ইয়াতিমদের ঘরের ভগ্ন দেয়াল মেরামত করা।

ঘ) যুল-কারনাইন এবং ইয়াজুজ ও মা’জুজের কাহিনীও এই সুরায় বর্ণনা করা হয়েছে।

জুলকারনাইন ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ ও সৎ বাদশাহ, তিনি পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত সফর করেছিলেন। দুই পর্বতের মাঝে তিনি এক জনগোষ্ঠীকে খুঁজে পেলেন। তারা তাঁর কাছে ইয়াজুজ ও মাজুজের হাত থেকে রক্ষা পেতে একটি দেয়াল নির্মাণের আবেদন জানাল। জুলকারনাইন কাজটি করে দিতে সম্মত হলেন। তিনি তাঁর কাজ নিয়ে গর্ব করেননি। দেয়াল নির্মাণের পর তাঁর দেওয়া ভাষণ কোরআনে এসেছে। ‘সে (জুলকারনাইন) বলল, এগুলো আমার মালিকের অনুগ্রহ, কিন্তু যখন আমার মালিকের নির্ধারিত সময় আসবে, তিনি এগুলো চূর্ণবিচূর্ণ করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবেন, আর আমার প্রভুর ওয়াদাই চূড়ান্ত সত্য।’ (আয়াত ৯৮)

পুরো সুরা জুড়ে আল্লাহ একটি বড় সত্য নানা উদাহরণের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন, তা হচ্ছে, বর্তমানের অবস্থা এবং নিকট ভবিষ্যতের সাফল্য-ব্যর্থতার কথা ভেবে, সত্যপথের নির্যাতন, ক্ষয়ক্ষতি, লাঞ্ছনা – ইত্যাদি দেখে ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলে চলবে না। বর্তমানের দুরাবস্থার মধ্যে নিহিত রয়েছে ভবিষ্যতের কল্যাণ। বর্তমানের মানুষদের সম্পদ ও ক্ষমতার দম্ভ ও চাকচিক্য দেখে আশাহত হওয়া, মন খারাপ করার কিছু নেই, সম্পদ ও ক্ষমতা ও নিরাপত্তার মালিক কেবলমাত্র আল্লাহ। মহান আল্লাহই উত্তম জানেন।

লেখকঃ লেখকঃ জামান শামস, কলাম লেখক এবং সাবেক এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প, কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক!  আপনি আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ;  মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই ।  আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

আরও পড়ুন