Ads

ঈদুল আযহার প্রকৃত তাৎপর্য

 ।। আলী ওসমান শেফায়েত ।।

১. ঈদুল আযহা হযরত ইবরাহীম (আ.), বিবি হাজেরা (আ.) ও ইসমাঈল (আ.)-এর পরম ত্যাগের স্মৃতি বিজড়িত উৎসব। ত্যাগের পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হওয়ার কারণেই ইবরাহীম (আ.)-কে পবিত্র কুরআনে মুসলিম জাতির পিতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে, “তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও” – [সূরা হাজ্জ: ২২/৭৮]। এ পরিবারটি বিশ্ব মুসলিমের জন্য ত্যাগের মহত্তম আদর্শ। তাই ঈদুল আযহার দিন সমগ্র মুসলিম জাতি ‘ইবরাহীমী সুন্নাত’ পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রাণপণ চেষ্টা করে থাকেন।

২. কুরবানী হলো আত্মশুদ্ধি এবং পবিত্রতার মাধ্যম। এটি সামাজিক রীতি হলেও আল্লাহর জন্যই এ রীতি প্রবর্তিত হয়েছে। তিনিই একমাত্র বিধানদাতা প্রতিমুহূর্তেই যার করুণা লাভের জন্য মানুষ প্রত্যাশী। আমাদের বিত্ত, সংসার এবং সমাজ তাঁর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত এবং কুরবানী হচ্ছে সেই নিবেদনের একটি প্রতীক।

৩. কুরবানীর মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর জন্য তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ত্যাগ করতে রাজি আছে কিনা সেটিই পরীক্ষার বিষয়। কুরবানী আমাদেরকে সেই পরীক্ষার কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। ইবরাহীম (আ.)-এর কাছে আল্লাহর পরীক্ষাও ছিল তাই। আমাদেরকে এখন আর পুত্র কুরবানী দেওয়ার মত কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় না। একটি হালাল পশু কুরবানী করেই আমরা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি। ঈমানের এসব কঠিন পরীক্ষায় যারা যত বেশি নম্বর অর্জন করতে পারবেন, তারাই তত বড় তাকওয়াপূর্ণ মানুষ এবং আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে সফল হতে পারবেন। ঈদের প্রকৃত আধ্যাত্মিক আনন্দ তারা ঠিক ততটাই উপভোগ করতে পারবেন যতটা তারা এ জাতীয় পরীক্ষায় সফল হবেন।

সন্তানকে মুমিন হিসেবে গড়ে তুলতে করণীয়

৪. কুরবানীর পশুর রক্ত মাটি স্পর্শ করার পূর্বেই আল্লাহর কাছে তা কবুল হয়ে যায়। আল্লাহর কাছে কুরবানী কবুল হওয়ার তাৎপর্য হচ্ছে: যে অকুণ্ঠ ঈমান আর ত্যাগের মহিমায় উদ্দীপ্ত হয়ে ইবরাহীম (আ.) স্বীয় প্রাণাধিক পুত্রের স্কন্ধে ছুরি উত্তোলিত করেছিলেন, কুরবানীর পশুর গলায় ছুরি দেওয়ার সময়ে কুরবানীদাতার হৃদয়তন্ত্রী সেই ঈমান ও ত্যাগের সুরে অনুরণিত হতে হবে। কুরবানীদাতার হৃদয়তন্ত্রী যদি সেই ঈমান ও ত্যাগের সুরে অনুরণিত না হয়ে উঠে, তাদের দেহ আর মনের পরতে পরতে যদি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের আকুল আগ্রহ উদ্বেলিত না হয়, তাহলে তাদের এই কুরবানীর উৎসব গোশত খাওয়ার পর্বেই পর্যবসিত হবে। আল্লাহ তায়ালা দ্ব্যর্থহীনভাষায় কুরবানীদাতাদের সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, “কুরবানীর পশুর গোশতও আল্লাহর কাছে পৌঁছেনা, তাদের রক্তও না। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছে যায় তোমাদের তাকওয়া” – (সূরা হাজ্জ: ২২/৩৭)।

৫. কুরবানী কেবল পশু কুরবানী নয়। নিজের পশুত্ব, নিজের ক্ষুদ্রতা, নীচতা, স্বার্থপরতা, হীনতা, দীনতা, আমিত্ব ও অহংকার ত্যাগের কুরবানী। নিজের নামায, কুরবানী, জীবন-মরণ ও বিষয়-আশয় সব কিছুই কেবল আল্লাহর নামে, শুধু তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য চূড়ান্তভাবে নিয়োগ ও ত্যাগের মানস এবং বাস্তবে সেসব আমল করাই হচ্ছে প্রকৃত কুরবানী। এই কুরবানী পশু যবেহ থেকে শুরু করে নিজের পশুত্ব যবেহ বা বিসর্জন এবং আল্লাহরপথে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানোর মাধ্যমে তার রাস্তায় শাহাদতবরণ পর্যন্ত সম্প্রসারিত। এই কুরবানী মানুষের আকাঙ্ক্ষা, নিয়ত, প্রস্তুতি ও গভীরতম প্রতিশ্রুতি থেকে আরম্ভ করে তার চূড়ান্ত বাস্তবায়ন পর্যন্ত সম্প্রসারিত।

৬. কুরবানী হচ্ছে মূলত একটি প্রতীকী ব্যাপার। আল্লাহর জন্য বান্দার আত্মত্যাগের একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। কুরবানীর থেকে শিক্ষা নিয়ে সারা বছরই আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রত্যাশায় নিজ সম্পদ অন্য মানুষের কল্যাণে ত্যাগের মনোভাব গড়ে উঠলে বুঝতে হবে কুরবানী স্বার্থক হয়েছে, কুরবানীর ঈদ স্বার্থক হয়েছে। নতুবা এটি নামমাত্র একটি ভোগবাদী অনুষ্ঠানই থেকে যাবে চিরকাল। এজন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল-কুরআনে বারবার ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। কুরবানির গোশত আল্লাহর কাছে যায় না।যতটুকু যায় বা রেকর্ড হয়ে থাকে তা হল আমাদের মনে খোদা-প্রেমের গভীরতার মাত্রা। কুরবানির গোশত দরিদ্রদের জন্য যতটুকু বিলিয়ে দেওয়া হয় কেবল সেটাই পরকালে আমাদের পাথেয় হয়ে থাকবে। আর যেটাকে আমরা আমাদের অংশ মনে করে কৃপণের ধনের মত আঁকড়ে আছি সেটাই বরং আমাদের কাছ থেকে হাতছাড়া হয়ে আছে যা আমরা জানি না।

ভারতের NEET তথা মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম আমিনা

আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হে ঈমানদারগণ! যে অর্থ তোমরা উপার্জন করেছো এবং যা কিছু আমি জমিন থেকে তোমাদের জন্য বের করে দিয়েছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট অংশ আল্লাহর পথে ব্যয় করো” – [সূরা বাকারাহ: ২/২৬৭]। কাজেই আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ মানবতার সেবায় ব্যয় করতে হবে। দরিদ্র মানুষের সহযোগিতায় সরকারের পাশাপাশি সকল বিত্তশালী লোককে এগিয়ে আসতে হবে। সারা বছর, সারাজীবন সাধ্যমত আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের কথা বিবেচনা করে মানুষকে সাহায্য করতে হবে। চিত্ত আর বিত্তের মিল ঘটানোর জন্যই আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বারবার মানুষকে আহবান করেছেন।

৭. কুরবানী কোনো লোক দেখানো বা গোশত খাওয়ার উৎসব নয়। কুরবানীতে যদি আল্লাহভীতি ও মনের একাগ্রতা না থাকে তাহলে এই সুবর্ণ সুযোগ বিফল মনোরথ ছাড়া আর কিছুই হবে না। আমাদের সমাজে আজ অনেককে বড় বড় পশু ক্রয় করে প্রদর্শন করা কিংবা বাহাদুরি জাহির করতে দেখা যায়। আবার অনেককে দেখা যায় গরিব-মিসকিনদের যথাযথভাবে না দিয়ে ঈদের দিন নিজেরা যৎসামান্য গোশত রান্না করে; আর বাকিটা ফ্রিজে রেখে দেয়। এরপর সারাবছর কিছু কিছু নিয়ে নিজেরা খায়। এসব কোনো মতেই প্রকৃত কুরবানীর পর্যায়ে পড়ে না। লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে বড় বড় গরু ক্রয় করে প্রদর্শন করা, বাহাদুরি জাহির করা অথবা গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানী করলে কুরবানী কবুল হবে না। তা কেবলমাত্র পশু জবাইয়ের আনুষ্ঠানিকতা হিসেবেই বিবেচিত হবে।

হজ্জ জীবনে একবার কিন্ত প্রভাব সারা জীবনের।। ১ম পর্ব

এসব পশুর রক্ত আর গোশত যেমন আল্লাহর নিকট যায় না তেমনি গ্রহণযোগ্যতা পায় না এগুলোর কুরবানীও।হালাল উপার্জন, ইখলাস ও একনিষ্ঠতাই হলো কুরবানী কবুল হওয়ার আবশ্যকীয় শর্ত। কে কত টাকা দিয়ে পশু ক্রয় করল, কার পশুটি কত মোটাতাজা বা সুন্দর, আল্লাহতা দেখেন না। তিনি দেখেন সহিহ নিয়ত ও তাকওয়া। মূলত আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গ করার জাযবা সৃষ্টি করা, ইবরাহীম (আ.)-এর পুত্র কুরবানীর ন্যায় ত্যাগ ও পূত আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করা ও তাঁর বড়ত্ব প্রকাশ করাই ঈদুল আযহার প্রকৃত তাৎপর্য।

লেখকঃ শিক্ষক ও সাহিত্যিক

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প  ও কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

ফেসবুকে লেখক আলী ওসমান শেফায়েত

আরও পড়ুন