Ads

থাম্ব রুলস ফর প্রফেশনালিজম ।। ১ম পর্বঃ সহমর্মিতাবোধ

।। এস এম আবু নাছের ।।

ফি বছর একটি নির্দিষ্ট দিনে বড় বড় বুলি কপচিয়ে শ্রমিকের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে শামিল হয় সব শ্রমিক আইন ভঙকারী রাঘব বোয়ালেরা। মিথ্যা আশ্বাস আর আগামীর সম্ভাবনার যে স্বপ্ন দেখানো হয় তার অধিকাংশই থাকে কাগজে কলমে। কর্পোরেট ব্যস্তময় দুনিয়ায় কাজের বোঝা যেমন ঘাড়ে চাপতে থাকে অনবরত, তেমনি এই স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টও করতে হয় সঠিক পন্থায়। একদিকে নিজের আমিত্বকে ধরে রেখে অন্যদিকে উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিভিন্ন হুকুম পালনের সময়ে অধিকাংশ চাকুরেই একটা গোলমেলে অবস্থার তৈরি করে। কখনও অতি তাবেদারি বা আনুগত্য প্রদর্শন করে দাসানুদাস ভৃত্যের ভুমিকা পালন করে আবার নানামুখী চাপে কখনও বা যথোপযুক্ত আনুগত্যের তোয়াক্বা না করেই চলতে থাকে। আবার যারা উপরের স্তরে বা নীতি নির্ধারণী ফোরামে কাজ করেন তারাও কখনও ছড়ি ঘুরাতে থাকেন যেন সব পিটিয়ে সোজা করা যাবে .  কিংবা এত ভাবলেশহীনভাবে চলতে থাকেন যে, প্রশাসনিক কার্যক্রম, অফিস ডেকোরাম কোন কিছুই আর ঠিক থাকে না।

বিগত এক দশকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন ঘটনার পরম্পরায় প্রফেশনালিজমের গদবাঁধা সংজ্ঞার বাইরে নতুন কিছু তুলে ধরার এক আকুতি কাজ করেছে মনের মাঝে সবসময়। কাজের চাপ, টার্গেট, স্যুটেড-বুটেড চোস্ত ইংলিশ বাবু সেজে থাকা, বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে জগাখিঁচুড়ি কথা বলার বাইরেও যে প্রফেশনালিজমের নতুন নতুন দিক রয়েছে, নতুনভাবে জানার রয়েছে, সেই জানালা উন্মুক্ত করে দেওয়ার প্রয়াসে আজ শুরু করছি “থাম্ব রুলস ফর প্রফেশনালিজম” নামে এক সিরিজ।

আমার সাথে ঘটে যাওয়া কর্পোরেট জীবনের ঘটনা ও প্রাত্যহিক আরও নতুন অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়ে আপনাদের সাথে শেয়ার করতেই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। এ যাত্রায় আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা আমার পথচলা সহজ করবে ইনশাআল্লাহ।  “থাম্ব রুলস ফর প্রফেশনালিজম”  সিরিজের প্রথম টপিক হিসেবে আলোচনা করব –

থাম্ব রুলস ফর প্রফেশনালিজম: এক-সহমর্মিতাবোধ

আরও পড়ুন-ব্যাংকে যোগ্য প্রার্থীর সংকট নাকি অন্য কিছু?

সহমর্মিতা এমন এক বৈশিষ্ট্য যা অনেকগুলো গুণের সমাহারে খুঁজে পাওয়া যায়। চাকুরী ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেকের যেমন নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব থাকে তেমনি মানুষ হিসেবেও কর্তব্যবোধ ও মনুষত্বের দাবী থাকে। আমার কর্মজীবনের অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি ইঁদুর দৌড়ের খেলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি কিংবা সহমর্মিতাবোধটুকু উবে যায়, হারিয়ে যায়। কাটখোট্টা মানুষ হিসেবে যেন দিনকে দিন নিজেকেই হারিয়ে ফেলে।

সহমর্মিতাবোধ এমন এক বৈশিষ্ট্য যা ভাষায় প্রকাশ করবার বিষয় যতটা তার চেয়ে ঢের বেশি অনুভব করবার। সহকর্মীদের মানসিক-শারীরিক অবস্থা কিংবা আবেগের উঠানামা সবকিছু চিন্তা করে মূল্যায়ন করার অপর নাম সহমর্মিতাবোধ।

বেশ কয়েকটা পয়েন্টে আলোচনা করি চলুন:

১। আপনার কলিগ রোজ সঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছায়। কোন একদিন হঠাৎ তার পৌঁছাতে দেরি হয়ে গেল। পৌঁছানোর পরে নানা রকম কৈফিয়ত, অনেক নীতিকথা শুনিয়ে দিলেন। বেচারা মনে মনে আপনার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছে । না হলে মন খারাপ করে আছে। কারণ এমন কিছু কারনে তার দেরি হয়েছে যা তার পক্ষে কোনভাবেই খন্ডন করা সম্ভব ছিল না। আপনি জানতেও চাইলেন না রাস্তায় কোন সমস্যা হয়েছিল কি না? তার গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে কি না? বাসায় কোন সমস্যা কি না? বাচ্চারা সুস্থ আছে কি না? একজন মানুষের জীবনের হাজারো অনুষঙ্গ থাকে। চাকুরি তার ছোট্ট একটা পার্ট। সব মিলিয়েই তার জীবন। হয়ত দু’কাঠি সরেস হয়ে বলেই দিলেন যে, সমস্যা আমাদেরও আছে, তাই বলে যেখান থেকে রুজী আসে সেইটার ব্যাপারে আগে ওয়াকিফহাল হতে হবে। ভাবলেন না যে, এই রুজী বা রোজগার তার এত পেরেশানির প্রয়োজনই হত না, যদি না তার জীবনে আরও মানুষ সাথে থাকত। তাই আগে উনার সেন্টিমেন্ট বুঝুন। কারণটুকু জানুন ও পরে যা বলার বলবেন। তবে বুঝিয়ে দিবেন। একজন দায়িত্বশীল অফিসার কখনোই ইচ্ছাকৃতভাবে গাফিলতি করেন না।

২। ব্যাংকের সার্ভিস ডেস্কে কর্তব্যরত অফিসার সারাদিন নানামুখী কাস্টমারের সেবা নিশ্চিত করেন। এর মধ্যে সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিংবা কোন গ্রাহক সেই সেবা পেয়ে যথেষ্ট পরিতৃপ্ত নাও হতে পারেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি এমন গ্রাহকেরা যখন উর্ধ্বতন কর্তার কাছে ঐ সংশ্লিষ্ট অফিসার সম্পর্কে অভিযোগ দায়ের করলে কর্তাবাবু তৎক্ষনাৎ অফিসারকে ডেকে এমন ব্যবহার করেন যেন, সেই অফিসার তুচ্ছাতিতুচ্ছ। একজন মানুষের মানবীয় দূর্বলতাও থাকা যাবে না। কিন্তু সেই মূহুর্তে গ্রাহক ও সংশ্লিষ্ট অফিসারের সাথে ব্যাপারটি নিয়ে খোলামেলা কথা বলে গ্রাহককে আশ্বস্ত করা ও অফিসার কর্তৃক এই কাজটি আরও কিভাবে সুন্দর করে ও গুছিয়ে করা যায় সে ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া অধিকতর জরুরী ছিল।

৩। মানুষ হিসেবে সুস্থতা ও অসুস্থতা স্বাভাবিক বিষয়। আপনার জুনিয়র কলিগ যখন আপনার কাছে তার অসুস্থতার কথা প্রকাশ করে, হতে পারে ঠান্ডা-জ্বর-সর্দি বা কাশি কিংবা অন্য কোন শারীরিক অস্বস্তি; তখন তার অসুস্থতার কথা শুনে আপনাকে অবশ্যই সহমর্মিতাবোধ জানাতে হবে। চায়ের দোকানে বসে লাল চা খেয়ে আর এক্সারসাইজ করলেই সর্দি-কাশির সমস্যা চলে যাবে। কিংবা “আপনাদের বয়সে আমার এমন অনেক হয়েছে, কোনদিন এসব পাত্তাই দিইনি” – এমন কথা আপনার ঐ কলিগের মন ভেঙে দেয়। আপনার প্রতি তার শ্রদ্ধা আর আস্থার জায়গাটুকু নষ্ট হয়। আপনার মৌখিক কিছু আশ্বাস বাণী ও সাহস তাকে কাজে অনুপ্রেরণা জোগাবে।

৪। কেউ সারাদিন অফিসের কাজে পরিশ্রম করে দিনশেষে আপনার সামনে বিদ্ধ্বস্ত চেহারায় দাঁড়ালে আপনার উচিত তার প্রতি সদয় হওয়া। দিনশেষে এই অফিসারগণ আপনার সাফল্যের নিয়ামক। তাদের কাজের ফলাফলের উপরেই আপনার সফলতা নির্ভর করে। তাই অফিসারদের প্রতি আপনার সহমর্মিতা তাদের মাঝে কর্মোদ্দীপনা তৈরি করে।

৫। সহমর্মিতার বিষয়টি যত টা না বাখ্যা করবার, তার চেয়ে অধিক অনুভব করবার। এখানে আপনার অফিসের সবচেয়ে ছোট পদের যে কর্মচারী তার ভূমিকার মূল্যায়ন ও আত্মসম্মানবোধের যেমন কদর করতে হয়, তেমনি প্রতিটি স্তরের যারা কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে তাদেরও মূল্যায়ন করতে হয় তাদের স্তর বিবেচনায়। কেউই ছোট নয় বরং সবাই তার নিজস্ব কাজের দায়িত্বে আদিষ্ট বা নিয়োজিত।

আরও পড়ুন-পেশা হিসাবে ব্যাংকিং কতটা নির্ভরযোগ্য ?

সহমর্মিতার গুরুত্ব,প্রয়োজনীয়তা এবং উপকারিতা

এতক্ষণ বললাম উদাহরণ। চলুন অল্প কথায় সেরে নিই সহমর্মিতার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা কিংবা উপকারিতার কথা।

১। কলিগদের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্কোন্নয়ন ঘটায়। অফিসের কাজের পরিবেশ গোছানো ও উন্নত হয়।

২। সকলের মধ্যে কাজের প্রতি আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায়। নিজের দায়িত্ব যথাযথ সম্পাদনে সচেষ্ট হয়।

৩। কোন ব্যক্তি যখন জানবে ও বুঝতে পারবে যে কেউ তাদের সমব্যাথী এবং সহমর্মী; তখন সে আস্থা পায় ও নিজের পরিকল্পনা ও আইডিয়াগুলো শেয়ার করতে পারে নির্দ্বিধায়  । যা একটি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনমূখিতাকে ত্বরান্বিত করে।

৪। সহমর্মিতাবোধ বজায় থাকলে তা অদৃশ্য এক বন্ধন তৈরি করে; যার ফলে ভুল বুঝাবুঝির পরিমাণ শূন্যের কোঠায় চলে আসে। একজন সহমর্মিতাবোধসম্পন্ন নেতা বা ম্যানেজারের কথায় বা সিদ্ধান্তে তার অধীনস্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারীগণ সহজেই একাত্মতা পোষণ করতে পারে। যে কোনও অফিসের কর্ম-পরিবেশের জন্য এইটি টনিক হিসেবে কাজ করে।

সহমর্মিতার প্রায়োগিকতা

এতক্ষণের আলোচনায় এইটি স্পষ্ট যে, প্রফেশনালিজমে সহমর্মিতা একটি প্রধান ও প্রনিধানযোগ্য আচরণ। তাহলে তা রপ্ত করা একজন প্রফেশনালিস্ট হিসেবে অবশ্যই অতীব জরুরী। আমি মাত্র দুইটি পয়েন্টে আপনাদেরকে এর প্রয়োগ শিখিয়ে দিই।

১। নিজের মনকে হালকা করে নিন। দুনিয়ার বানানো সকল রীতি দূরে ঠেলে নিজেকে আপনার জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখুন। আর অন্যের প্রতিটা অনুভূতি, অসুবিধা, আক্ষেপ, উচ্ছ্বাসগুলোকে একদম নিজের আঙিকে ভেবে দেখুন। শুধু নিজের আঙিকে নয় বরং তার দিকটি বিবেচনা করুন। খুব প্রচলিত একটা কথা আছে না, Keep your legs in his shoes and then decide. অর্থাৎ সিদ্ধান্ত নেবার আগে বা কোন প্রতিক্রিয়া জানানোর আগে তার জুতো পরিধান করে নিন। আসলে তার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করুন। দেখবেন, আপনি নিজের অজান্তেই কখন যে, সহমর্মিতাবোধসম্পন্ন একজন মানবিক মানুষ হয়ে উঠবেন আর এই গুণাবলী আপনাকে নেতৃত্বের আসনে আসীন করবে।

২। প্রতিক্রিয়া জানানোর একটা মনোবৈজ্ঞানিক নিয়ম বা কৌশল রয়েছে যা আপনাকে রিয়্যাক্টিভ, সেন্সিটিভ এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে অধিক সচেতন করে তুলবে। কৌশলটি হল: ফাইভ সেকেন্ড রুলস (৫ মিনিটের নিয়ম)।

আপনার অফিসে কাজ করছেন বা কোন আলোচনায় আছেন, এমন মূহুর্তে কোন কলিগ আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে কোন কথা বলছে, আপনি ৫ সেকেন্ডের মধ্যে তার দিকে ফিরে হাতের কাজ রেখে দিন। তার কথায় মনযোগ দিন। হয়ত আপনার মনযোগ বা ফিরে তাকে সময় দেওয়াটাও খুব অল্পক্ষণ হতে পারে, ২০ সেকেন্ড বা ১ মিনিট। কিন্তু আপনি যে তার কথায় আপনার কাজ রেখে গুরুত্ব দিয়েছেন, এর ফিলে সে নিজেকে গর্বিত অনুভব করবে এবং আপনার প্রতি মানসিকভাবেই দূর্বল হয়ে পড়বে। কখনোই আপনার সহকর্মীদের কথার জবাবে হুম, আচ্ছা, দায়সারা গোছের কিছু বলে চালিয়ে দিবেন না। একজন ভাল নেতা বা সুদক্ষ চাকুরে হতে গেলে প্রফেশনালিজমের এই থাম্ব রুলস আপনাকে অবশ্যই মেনে চলতে হবে।

লেখকঃ প্রাবন্ধিক এবং এক্সিকিউটিভ অফিসার ও ম্যানেজার,যমুনা ব্যাংক পিএলসি,সতীহাট উপশাখা, মান্দা, নওগাঁ

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প  ও কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

ফেসবুকে লেখক এস এম আবু নাসের

আরও পড়ুন