Ads

পানি বণ্টনে মমতার অবস্থান ও আন্তর্জাতিক আইন

।। ড. মো. নূরুল আমিন ।।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী গত ২৪ জুন সোমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে একটি পত্র লিখেছেন। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত পত্রের বিস্তারিত বিষয়বস্তু অনুযায়ী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে তার সরকারের অংশগ্রহণ ছাড়া তিস্তা এবং ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের সাথে যেকোনো রকম চুক্তিতে তার তীব্র আপত্তি রয়েছে। তার ভাষায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বার্থ নিয়ে আমি কোনো আপোষ করব না।

চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে  তিনি বলেছেন যে, গঙ্গা ও তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে হয়ত আপনার কিছু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকারের কোনো মতামত না নিয়ে এমন একতরফা আলোচনা কাঙ্ক্ষিত বা গ্রহণযোগ্য নয়। মমতা জানিয়েছেন ছিটমহল বিনিময়, রেল ও বাস যোগাযোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিবিড় হয়েছে। কিন্তু পানি অত্যন্ত মূল্যবান। প্রাণ ধারণের রসদ নিয়ে কোনো সমঝোতা করতে আমরা প্রস্তুত নই। পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে পানি বণ্টনের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। আনন্দবাজারের রিপোর্ট অনুযায়ী ২৪ জুন বিকেলে এক সাংবাদিক সম্মেলনেও মমতা বন্দোপাধ্যায় পানি বণ্টন নিয়ে নয়াদিল্লী-ঢাকা দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তার অভিযোগ চীনকে দিয়ে বাংলাদেশ তিস্তার ওপর ড্রাম বানিয়েছে। বলাবাহুল্য এর আগে ২২ জুন শনিবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক বৈঠকে ‘ফারাক্কা-গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি নবায়নের জন্য’ যৌথ কারিগরি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ওই দিনই তৃনমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করা হয়।

মোদিকে পাঠানো চিঠিতে মমতা লিখেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের জনজীবনে গঙ্গার পানির গুরুত্বের পাশাপাশি ফারাক্কা থেকে পাওয়া জল কোলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখার ক্ষেত্রেও বড় ভরসা। ফারাক্কা ফিডার ক্যাসেলের মাধ্যমে অন্তত ৪০ হাজার কিউসেক পানি পেলে কোলকাতা বন্দরের নাব্য বজায় রাখা সম্ভব। তা না হলে গঙ্গায় পলি পড়ে কোলকাতা বন্দর জাহাজ চলাচলের উপযোগী নাব্য হারাতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা তার পত্রে তিস্তার পানি বণ্টনের কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে, সিকিমে পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে তিস্তার গুরুতর স্বাস্থ্যহানি ঘটেছে, পরিবেশের ওপরও গুরুতর প্রভাব পড়েছে। দেখে আশ্চর্য হচ্ছি, তিস্তার ভারতীয় অংশের স্বাস্থ্য ফেরাতে পানি শক্তি মন্ত্রকের কোনো উদ্যোগই নেই। সিকিমে পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে তিস্তার পানি প্রবাহ কমেছে এবং তাতে উত্তরবঙ্গের কৃষকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০২৩ সালের প্রথম দিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের বাস্তবায়নাধীন একটি প্রকল্পে ব্যবহার করার জন্য তিস্তা নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে তার পানি প্রকল্প এলাকায় প্রবাহিত করার লক্ষ্যে দুটি খাল খননের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ওই সময় বাংলাদেশ সরকার তিস্তার পানি প্রত্যাহারের ভারতীয় সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দাবি করে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন।

তিতস্তা বাঁধ

বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী এবং আমাদের উত্তরাঞ্চলের প্রায় ১৫টি জেলা তিস্তার পানির উপর নির্ভরশীল। এই জেলাগুলো সেচ চাহিদা পূরণ করার জন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশ তিস্তানির্ভর একটি বৃহৎ সেচ ও পানি নিষ্কাশন প্রকল্পের নির্মাণ কাজও সম্পন্ন করেছে এবং কয়েক দশক ধরে সম অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পানি পাওয়ার চুক্তি সম্পাদনের জন্য ভারত সরকারের ‘অনুকম্পা’ কামনা করে আসছে। ২০১১ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং-এর বাংলাদেশ সফরের সময় এই পানি ভাগাভাগি নিয়ে একটি চুক্তি সম্পাদনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতায় তা আর হয়নি।

ঐ সময় অনেকেই ধারণা করেছিলেন যে, বাংলাদেশ তিস্তার পানিচুক্তি সম্পাদিত না হলে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেবে না এবং এ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করবে না। কিন্তু তা হয়নি, বাংলাদেশ ভারতকে তার চাহিদা অনুযায়ী ট্রানজিট, করিডোর, সমুদ্র ও নদীবন্দর, রেলওয়ে সবকিছু ব্যবহারের সুবিধাই শুধু দেয়নি বরং সম্পূর্ণ আঞ্চলিক উৎসসম্পন্ন ফেনী নদীর পানিও ভারতকে দিয়ে দিয়েছে। এর প্রতিবাদ করে ফেসবুকে স্টেটাস দেয়ায় আবরার নামক প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে।

আরও পড়ুন-

ইতিহাসের অজ্ঞতা গোলামী ডেকে আনতে পারে ।। ১ম পর্ব

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে এ পর্যন্ত যত চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে অথবা সম্পাদনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে সেগুলোর বিস্তারিত তথ্য আমরা বাংলাদেশের জনগণ জানি না। এ প্রেক্ষিতে ২০১১ সালে দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় খসড়া তিস্তা চুক্তিতে পানি ভাগাভাগির যে তথ্য এসেছে তার কোথাও ৫০:৫০, অথবা কোথাও ৫২:৪৮-এর ভিত্তিতে পানি ভাগাভাগির কথা উল্লেখ ছিল। টাইমস অব ইন্ডিয়া ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মেয়াদে বাংলাদেশকে ৩৩ হাজার এবং ভারতকে ৫০ হাজার কিউসেক পানি দেয়ার কথা উল্লেখ ছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যে সময়ের কথা এতে উল্লেখ করা হয়েছে সে সময়ে বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত পানি অপর্যাপ্ত বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী শুষ্ক মওসুমে আমাদের পর্যাপ্ত পানির নিশ্চয়তা প্রয়োজন। খসড়া চুক্তিতে তা ছিলো না। কিন্তু তথাপি ওয়েস্ট বেঙ্গল পলিওশন কন্ট্রোল বোর্ড কঠোরভাবে এই চুক্তির বিরোধিতা করেছে। বাংলাদেশের অনেকেই জানেন না যে, পশ্চিম বাংলা সরকার ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদনক্রমে একটি বিশাল সেচ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এবং এই উদ্দেশ্যে তিস্তা নদীর গজলডোবা পয়েন্ট ছাড়াও মহানন্দা এবং ডাওক নদীর ওপর তিনটি বাঁধ তৈরি করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে তারা ৯.২২ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান ছাড়াও ৬৭.৫০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে এজন্য মোট ব্যয়ের ৯০ শতাংশ অনুদান হিসেবে প্রদান ঘোষণা দেয়া হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্পটিকে জাতীয় প্রকল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ২০১০ সালে এই উদ্দেশ্যে ২৯৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার সময়সীমাও বেঁধে দেয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী এই সময়ের মধ্যে যদি প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত না হয় তাহলে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অর্থ রাজ্য সরকারকে ঋণ হিসেবেই গ্রহণ করতে হবে বলে সতর্ক করে দেয়া হয়। আরো জানা গেছে যে, এই প্রকল্পের অধীনে সেচ খাল, সেচ নালা ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের জন্য ১৫০০০ হেক্টর জমির প্রয়োজন। যার মধ্যে ২০১০ সাল যাবৎ রাজ্য সরকার ১০৫০০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করেছিল। অবশিষ্ট জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে ক্ষমতায় আসার আগে মমতা ব্যানার্জী আপত্তি তুলেছিলেন। ক্ষমতায় আসার পর এই বিষয়টি তার মন্ত্রিসভায় পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করা হয়। এই অবস্থায় তিস্তা প্রকল্পের স্বার্থে শুধু পশ্চিমবঙ্গ সরকার নয়, কেন্দ্রীয় সরকারও বাংলাদেশকে তিস্তার পানির হিস্যা দিতে আদৌ আন্তরিক কিনা সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান।

এই চুক্তি নিয়ে ইতোমধ্যে West Bengal Pollution Control Board থেকে অনেকগুলো প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে প্রথমত তিস্তা নদীর মাত্র ১৬ শতাংশ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এবং এ দেশটির তিস্তা বিধৌত এলাকার পরিমাণ হচ্ছে ১২৩৬১ বর্গ কিলোমিটার। এই এলাকায় যে বৃষ্টিপাত হয় তার ফলে সৃষ্ট পানির পরিমাণ হচ্ছে ২.১১৭ বিলিয়ন ঘনমিটার। পক্ষান্তরে ভারতীয় এলাকায় বৃষ্টির ফলে প্রাপ্ত পানির পরিমাণ হচ্ছে ১২.২৬ বিলিয়ন ঘনমিটার। Pollution Control Board-এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী জুলাই মাসে তিস্তার প্রবাহ হচ্ছে সর্বোচ্চ ৭০,০০০ কিউসেক এবং জুন-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই নদীর পানি প্রবাহ পর্যাপ্ত হলেও শুষ্ক মওসুমে তা ৩৫০০-৪০০০ কিউসেকে নেমে আসে। তারা মনে করেন যে, পানি ভাগাভাগি করতে হলে এই বিষয়গুলোকে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। এর দুটি অর্থ দাঁড়ায়, একটি হচ্ছে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশ কোনও পানিই পেতে পারে না এবং দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে বাংলাদেশকে যদি পানি দিতেই হয়, তাহলে ঐ সময়ের প্রবাহে ৬-৭ শতাংশের বেশি দেয়া যায় না। এখন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী রাজনীতিকরা সমস্যার গভীরতা অনুধাবন করার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। এর সাথে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক অবস্থাও মিলিয়ে দেখতে পারেন।

এখন আমি আন্তর্জাতিক নদীর পানি বণ্টন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উজানের যে কোন দেশ ভাটির দেশকে নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে বাধ্য। যে নদীর প্রবাহ নির্দিষ্ট কোনও দেশের নিজস্ব সীমানা ও ভূখন্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় এবং তা তার সীমানা পেরিয়ে অন্য দেশের ভূখন্ডের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সেই নদীর পানির ওপর উজান ভাটি উভয় দেশের অধিকার সমান।

এ প্রেক্ষিতে একক সিদ্ধান্তে কোনও দেশ যেমন তার ওপর দিয়ে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক কোনও নদীর পানি প্রত্যাহার করতে পারে না, তেমনি ভাটির দেশে পানি প্রবাহে বাধার সৃষ্টি কিংবা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কোনও পদক্ষেপও গ্রহণ করতে পারে না। ১৯১১ সালে ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ল (Institut de Dron’t International)-এর উদ্যোগে সম্পাদিত মাদ্রিদ চুক্তিতে পরিষ্কার বলা হয়েছে:

‘A state is forbidden to stop or divert the flow of a river which runs from its own to a neighbouring state but likewise to make such use of the water of the river as either causes danger to the neighbouring state or prevent it from making proper use of the flow of the river on its part’

আবার একই বিষয়ে হেলসিংকি বিধিমালার (Helsinki Rules) ৪ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে -‘Each basin state is entitled, within its territory to a reasonable and equitable share in the beneficial uses of the waters of an international drainage basin.’

আরও পড়ুন-

ভারতের বিস্মৃত স্বাধীনতা সংগ্রামী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ

আন্তর্জাতিক আইন এবং চুক্তিসমূহে বিধৃত এই নীতিমালাগুলো অত্যন্ত পরিষ্কার। এখানে স্বেচ্ছাচার বা অযৌক্তিকভাবে আন্তর্জাতিক নদী ও স্রোতধারাসমূহের পানি সরবরাহ থেকে কোনও দেশকে বঞ্চিত করা যায় না। কাজেই উজানের দেশ কিংবা নদীর উৎসস্থল হিসেবে বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীর পানি থেকে ভারত বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার কোনও সুযোগ নেই।

১৯৯৭ সালে এ ব্যাপারে জাতিসংঘের সাধারণ কাউন্সিলে গৃহীত Convention on the Law of non navigational uses of international water courses ও প্রণিধানযোগ্য। এতে সহযোগিতা ও সমবায়ের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক নদীসমূহের পানি ব্যবহারের আইনি কাঠামো প্রদান করা হয়েছে যা অনুসরণ করা সদস্য দেশগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক। এতে নদীর পানির ব্যবহারকে দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এর একটি হচ্ছে Consumptive use এবং অন্যটি non-consumptive use. consumptive use হচ্ছে পানির ঐসব কাজে ব্যবহার যাতে নদী থেকে পানি প্রত্যাহৃত হয় এবং এর ফলে পানির প্রবাহ ও গভীরতা হ্রাস পায়। নৌচলাচলের কাজে পানির ব্যবহার হচ্ছে non-consumptive use. এর ফলে নদীর পানি হ্রাস পায় না। জাতিসংঘের এই Law convention-এ ১৯৬৬ সালের হেলসিংকি বিধিমালায় বিধৃত আন্তর্জাতিক ওয়াটার কোর্সের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়। হেলসিংকি বিধিতে এই সংজ্ঞায় নিষ্কাশন অববাহিকার ধারণা ব্যবহৃত হয়েছিল। কনভেনশনে এই সংজ্ঞা পাল্টিয়ে একে বলা হয়েছে, , ‘A system of surface waters and ground waters constituting by virtue of their physical relationships a unitary whole and normally flowing into a common terminus… parts of which are situated in different statesÕ (Article 2(a), (b)। বলাবাহুল্য, এখানে আন্তর্জাতিক নদী বা পানি প্রবাহকে শুধুমাত্র ভূউপরিস্থিত প্রবাহের মধ্যে সীমিত রাখা হয়নি, ভূগর্ভস্থ পানি পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়েছে। জাতিসংঘ কনভেনশন কর্তৃক গৃহীত আন্তর্জাতিক নদী সংক্রান্ত এই আইনগত কাঠামোর বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে:’

  1. It creates a legal framework for equitable utilization of the waters for trans boundary rivers;
  2. It calls for development, conservation, management and protection of international water course and optimal and sustainable utilization for the present and future generations;
  3. It recognizes relevant factors in equitable utilization of waters, taking into account geographic, hydrographic, hydrological, climatic, ecological and other factors;
  4. It requires co-riparian countries to exchange data and information on trans boundary rivers;
  5. It envisages co-riparian countries taking appropriate measures of prevent harm to other co-riparian states;
  6. It recognizes no party can adversely affect uses of other countries without the consent of other countries.
  7. It affirms the importance of co-operation and good neighborliness of all riparian states.

জাতিসংঘ কনভেনশনের উপরোক্ত আইন কাঠামোটি থেকে এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, আন্তর্জাতিক নদী অথবা একাধিক দেশের সীমানা ডিঙিয়ে প্রবাহিত স্রোতধারার পানির উপর একক কোনও দেশ মালিকানা দাবি করে তার যথেচ্ছ প্রত্যাহার বা ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে পারে না, বিশেষ করে উজানের দেশ তো নয়ই। এসব নদী ও স্রোতধারার উন্নয়ন সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা এবং সুরক্ষার ব্যবস্থা করা সংশ্লিষ্ট সকল রাষ্ট্রের দায়িত্ব যাতে করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সকল বংশধরের জন্য এই নদী বা নদীসমূহের পানির টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।

এই আইন কাঠামোতে উজান ও ভাটির দেশসমূহের মধ্যে নদী সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্তের বিনিময়ের উপর যেমন গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তেমনি উজানের দেশ যাতে ভাটি তথা নিম্ন অববাহিকার দেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু করতে না পারে তার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পানি বিজ্ঞান, পানির ভৌগোলিক গতিপ্রবাহ আবহাওয়া পরিবেশ-প্রতিবেশ প্রভৃতি উপাদানসমূহকে বিবেচনা করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কোনও রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের সম্মতি ছাড়া এমন কোনও কিছু করতে পারবে না যাতে অন্য রাষ্ট্রের পানি ব্যবহারের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে।

আন্তঃসীমান্ত প্রবাহী নদী সংক্রান্ত উপরোক্ত আন্তর্জাতিক আইনসমূহের প্রেক্ষাপটে আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে পতিত ভারতীয় উৎস কিংবা উৎস বহির্ভূত যতগুলো নদী ও স্রোতধারা বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তার প্রত্যেকটির পানির ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তি বাংলাদেশের অধিকার, তাকে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোনও অধিকার ভারতের নেই। এই নিরেট সত্যটি প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ শুধু ভারতের শুভেচ্ছার উপর নির্ভর করে নিদ্রামগ্ন হয়ে থাকতে পারে না। এ জন্য যেমন তার দ্বিপাক্ষিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন তেমনি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণও অপরিহার্য। ভারতের প্রেমে অন্ধ আমাদের সরকার এই অপরিহার্য কাজটি করেননি বা করছেন না।

প্রথমত ১৭.৫ কোটি মানুষ ও তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জীবন মরণের সমস্যার এই বিষয়টি সরকার এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উত্থাপন করেনি। আবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমস্যাটি উত্থাপন কিংবা আন্তর্জাতিক প্রতিকার পাবার জন্য যে অধিকার ও যোগ্যতার প্রশ্নটি রয়েছে তাও আমাদের বেলায় প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয় বলে মনে হয়। Trans-boundary Rivers সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের সুবিধা ও প্রতিকার পাবার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে এ সংক্রান্ত জাতিসংঘ কনভেনশনের অনুসমর্থন (Ratification)। বাংলাদেশ এই কনভেনশনটি অনুসমর্থন করেনি। কেন করেনি শেখ হাসিনার সরকারই তার জবাব দিতে পারবেন।

১৯৯৭ সালে তিনিই ক্ষমতায় ছিলেন এবং এখনো তিনি আছেন। এই অবস্থায় শুধু তিস্তা নয় ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর পানির জন্যই বাংলাদেশ ভারতের করুণানির্ভর হয়ে পড়েছে। ভারত যে পানি দেবে তার নিশ্চয়তা আমরা পাইনি। মমতা ব্যানার্জীর সীমাবদ্ধতা ও দায়ের বিষয়টি তো অন্যস্থানে।

আরও পড়ুন-

ইসলাম বিরোধী মেডিয়া যাদের মুসলিম বানালো !

মমতা বন্দোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন নেত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় জনগণের প্রতি যে দায় ও জবাবদিহিতা থাকা দরকার তার চরিত্রে তার পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন পাওয়া যায় এবং সেই প্রেক্ষাপটে তিনি পানি নিয়ে কোনো আপোষ করতে রাজি নন। শুধু তিস্তা নয় ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি নবায়নেরও তিনি বিরোধিতা করেছেন। পক্ষান্তরে এসব ক্ষেত্রে আমাদের সরকারের অবস্থান কী? বিনা শর্তে আমরা ভারতকে ট্রানজিট-করিডোর দিয়েছি। সমুদ্র ও নদীবন্দর ব্যবহার করতে দিয়েছি। পাম্প বসিয়ে ফেনী নদীর পানি ত্রিপুরা রাজ্যে নিয়ে যাবার অবাধ স্বাধীনতা ও অধিকার দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ‘ভারতকে যা দিয়েছি চিরদিন তা তাদের মনে থাকবে।’ তারা যা চেয়েছে তা পেয়েছে, যা চায়নি তাও পেয়েছে। আমাদের প্রাপ্তির ঘর শূন্য কেন?

আগেই বলেছি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ১৫টি জেলা চাষাবাদ ও দৈনন্দিন কাজের জন্য তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল। এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৫৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান আমলে তিস্তা বাঁধ প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু ভারতের বিরোধিতার কারণে প্রকল্পটির অর্থায়নের জন্য কোনো দাতা সংস্থা এগিয়ে আসেনি। ১৯৭৫ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক অর্থায়নে রাজি হয় এবং ১৯৭৯ সালে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এর অধীনে লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা উপজেলায় তিস্তা নদীর ওপর ৬১৫ মিটার দীর্ঘ একটি বাঁধ নির্মাণ করে তাতে ১২,৭৫০ কিউসেক পানি নিঃসরণ ক্ষমতা সম্পন্ন ৪৪টি গেট স্থাপন করা হয় এবং প্রায় ১৬ লক্ষ একর জমিতে পানি সেচের জন্য ৭,৮০০ কিলোমিটার সেচ নালা খনন করা হয়, এই নালা খননের জন্য বহু দরিদ্র কৃষকের জমি হুকুম দখল হওয়ায় তাদেরকে নিঃস্ব হতে হয়েছে। ১৯৯০ সালে এই প্রকল্পটির কাজ সমাপ্ত হয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ ভারত এই নদীর উজানে গজলডোবায় আরেকটি বাঁধ দেয়ার ফলে শুষ্ক মওসুমে এই প্রকল্পে পানি সংকট দেখা দেয়। তারা বর্ষা মওসুমে নিজেদের ভূখণ্ডকে বন্যামুক্ত রাখার জন্য ওই বাঁধের পানি ছেড়ে দেয়। ফলে বাংলাদেশের তিস্তা বিধৌত এলাকা প্লাবিত হয়, মানুষের ঘর-বাড়ি ও ফসলের জমি পানির নিচে চলে যায় এবং তারা নদী ভাঙনের কবলে পড়ে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র পথ হচ্ছে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা যে অবস্থান নিয়েছেন আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে তা সঠিক নয়। আন্তর্জাতিক নদীর পানি থেকে উজানের দেশ ভাটির দেশকে বঞ্চিত করতে পারে না।

লেখকঃ প্রাবন্ধিক , গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব  এবং সিনিয়র সহকারী সম্পাদক, দৈনিক সংগ্রাম

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প  ও কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

আরও পড়ুন