Ads

বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট ।। একটি পর্যালোচনা

।। ড. মো. নূরুল আমিন ।।

গত ৬ জুন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেছেন। তার ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৪-২৫ সালের প্রস্তাবিত বাজেটের পরিমাণ ৭,৯৭০০০ কোটি টাকা এর মধ্যে উন্নয়ন বাজেট তথা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) পরিমাণ হচ্ছে ২,৬৫,০০০ কোটি টাকা।

অর্থমন্ত্রী বাজেটে অর্থ সংস্থানের জন্য আয় ধরেছেন ৫,৪১,০০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাবদ ১১৮৭৮৩ কোটি, আয় ও মুনাফা থেকে ১৭৫,৬২০ কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক বাবদ ৬৪,২৭৮ কোটি টাকা, আমদানি শুল্ক বাবদ ৪৯৪৬৪ কোটি এবং কর বহির্ভূত অন্যান্য প্রাপ্ত বাবদ ৪৬০০০ কোটি টাকা। পক্ষান্তরে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ১১১,১৫৬ কোটি, সুদ পরিশোধ খাতে ১১৩,৫০০ কোটি, ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ ৮৮২৮৩ কোটি টাকা, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৮১৪৭৭ কোটি টাকা, জনপ্রশাসন ৫৮,২৯৫ কোটি টাকা, কৃষি খাতে ৩০০৭০ কোটি টাকা, জ¦ালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ৩০৩১৬ কোটি টাকা, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাতে ৩২২১৭ কোটি টাকা, প্রতিরক্ষা খাতে ৩৪২০৫ কোটি টাকা, পেনশন ও গ্র্যাচুইটি খাতে ৩৬৯১২ কোটি টাকা, সামাজিক কল্যাণ ও নিরাপত্তা খাতে ৩৭৯৩৯ কোটি টাকা, স্বাস্থ্য খাতে ৪১৪০৮ কোটি টাকা, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন খাতে ৪৭৩৩৯ কোটি টাকা ও অন্যান্য খাতে ৫৩২৮৩ কোটি টাকা।

বলাবাহুল্য, আয়ের খাতে এনবিআরভুক্ত আয়ের পরিমাণ হচ্ছে ৭৮৫৫ কোটি টাকা এবং এনবিআর বহির্ভূত করের পরিমাণ হচ্ছে ১৫০০০ কোটি টাকা। ব্যয় থেকে আয় বাদ দিলে ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ২৫৬০০০ কোটি টাকা। এই ঘাটতি পূরণের জন্য অর্থমন্ত্রী ১৩৭৫০০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ (দেশীয়) ২৩৪০০ কোটি টাকার ব্যাংক বহির্ভূত ঋণ এবং ৪৪০০ কোটি টাকার বিদেশী অনুদান প্রাপ্তির আশা প্রকাশ করেছেন।

অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে চারটি অগ্রাধিকার ঘোষণা করেছেন। এগুলো হচ্ছে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, স্বাস্থ্য খাতকে উন্নত করা, বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের পরিবেশ উন্নত করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা বা জিরো টলারেন্স ঘোষণা। এছাড়াও তিনি রফতানি পণ্য বহুমুখীকরণের উপর জোর দিয়েছেন। তিনি আসবাব ও বহুমুখী পাটজাত পণ্যের কথা বলেছেন এবং লজিস্টিক খাতকে অগ্রাধিকার তালিকায় এনেছেন। তার বক্তৃতায় এই অংশটি আকর্ষণীয় এবং আশাব্যাঞ্জক বলে মনে হয়েছে। কিন্তু এই আশা বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর কোনো দিকনির্দেশনা বা কর্মসূচি এর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না।

আরও পড়ুন-অমুসলিম দেশ নিয়ে সমীক্ষার ফলাফল ও ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য !

সহযোগী একটি পত্রিকার একজন শিল্পী অর্থমন্ত্রীর এই বাজেট ঘোষণাকে কেন্দ্র করে এই সুন্দর চিত্র এঁকেছেন। এতে দেখা যায় যে, অর্থমন্ত্রী একটি ওভারলোডেড ঠেলাগাড়ির সামনে দুই হাতল ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। ঠেলা গাড়িটি দেশের অর্থনীতির, এতে পণ্যসামগ্রীর বিশাল স্তূপের মধ্যে জড়োসড়ো হয়ে বর্ষীয়ান একজন মহিলাও বসে আছেন, ‘দেখে মনে হয় চিনি তাহারে’ আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঠেলাগাড়ির একটি চাকা দৃশ্যমান, আরেকটি দেখা যায় না। চাকার জায়গায় সেখানে অর্থনীতির পাশেই জিহ্বা বের করা একজন লোককে অত্যন্ত বিব্রতকর অবস্থায় দেখা যায়। তার পেছনে তিনজন লোক দেখা যায়, একজনকে আমাদের দরবেশ সাহেবের মতো মনে হয়। তারা বাহবা দিচ্ছেন বলছেন, ইভরিথিং ইজ ফাইন, সব কুচ ঠিক হায়। ঠেলাগাড়ির ওভার লোডেড মালামালের মধ্যে রয়েছে ডলার সংকট, ব্যাংক সংকট, বিদেশী ঋণের চাপ, লোডশেডিং, মূল্যস্ফীতি, অর্থ পাচার, দ্রব্যমূল্য, বেকারত্ব ও জীর্ণশীর্ণ মানুষের কংকাল বা ধ্বংসাবশেষ। অর্থমন্ত্রী ঠেলাগাড়ি টেনে সামনে নিতে পারছেন না, মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী তার চাকাটা ঠেলে এগিয়ে দিচ্ছেন। এই ছবিটি আমার কাছে বাজেট ও আমাদের জাতীয় অর্থনীতির একটি বাস্তব প্রতিচ্ছবি বলেই মনে হয়েছে। বাজেট বিশ্লেষণের আগ্রহ আমি হারিয়ে ফেলেছি।

আগামী বছরের জন্য অর্থমন্ত্রী ঘোষিত এই বাজেটকে সিপিডির একজন প্রবীণ অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ বেনজির বাজেট বলে আখ্যায়িত করেছেন। এর দুটো অর্থ হতে পারে। এক. অতীতে এ ধরনের বাজেটের আর কোনো নজির বা দৃষ্টান্ত নেই, দুই, বেনজির এখন, দুর্নীতি, অপচয় ও ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রতীক। সরকার তাকে সৃষ্টি করেছেন দুধ-কলা দিয়ে। পুষেছেন, নিজের স্বার্থ হাসিল করে তাকে মোটাতাজা করেছেন এবং অবসর গ্রহণের দিন জনরোষ থেকে রক্ষার জন্য ইউনিফরমধারী সশস্ত্র দুইজন দেহরক্ষী ও সিভিল ড্রেসে পুলিশ এসকট দিয়ে তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন। হাইকোর্ট তার সম্পত্তি ক্রোক, ব্যাংক একাউন্ট জব্দ ও সম্পত্তির দলিল বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দিলেও তিনি সরকারের দেয়া পুলিশ প্রটেকশন নিয়েই বুক ফুলিয়ে দেশত্যাগ করেছেন।

অর্থমন্ত্রীর বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতি করার অবাধ লাইসেন্স দিয়ে দেয়া হয়েছে। অডিটের ভয়ে যারা অর্থ সম্পদের সত্যিকার তথ্য লুকিয়ে রাখেন তাদের সীমাহীন উৎসাহ প্রণোদনা দিয়েছেন পক্ষান্তরে বৈধ টাকার মালিক সৎ ব্যবসায়ীদের উপর দুর্নীতিবাজদের তুলনায় দ্বিগুন হারে করারোপ করে অর্থনীতির সাবলীল প্রবৃদ্ধির কোমর ভেঙে দিয়েছেন। বিদেশে পুঁজি পাচারকারী ও ব্যাংকের ঋণ খেলাপকারীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় ও তাদের অপরাধের জন্য শাস্তি বিধানের কোন ইঙ্গিতও বাজেটে নইে। এডিপি হচ্ছে উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের জন্য বাজেট নির্ধারিত একমাত্র কর্মসূচী তথা Government Institution অন্যান্য বছরের ন্যায় এবছরও এডিপি বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। এটা বাজেট ঘাটতির তুলনায় মাত্র ৯০০ কোটি টাকা বেশি অর্থায়নের উৎসও অনিশ্চিত। সরকার আভ্যন্তরীণ উৎস থেকে যে বিশাল অংকের ঋণ নেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন তা বেসরকারি খাতকে দুর্বল করে দিবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকসমূহের অবস্থা এখন অত্যন্ত নড়বড়ে। অর্ধশতকেরও বেশি দেশি বিদেশি ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ আটটি ব্যাংক ছাড়া আর সবগুলো ব্যাংকের তারল্য সকট (নগদ অর্থ) প্রবল, চাহিদামত আমানতদাতাদের টাকা দিতে অপারগ, সরকার সবল ও দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে ব্যাংকের সংখ্যা কমাতে ব্যস্ত লগ্নিকৃত অর্থ ব্যাংকগুলো ফেরত পাচ্ছেনা, এমনকি অনেকগুলো সরকারি বেসরকারি ব্যাংক মূলধনও খেয়ে বসে আছে সেই অবস্থায় সরকার যে বিশাল অংকের ঋণ তাদের কাছ থেকে নেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে তা তাদের দেউলিয়াপনাকে শুধু ত্বরান্বিত করবেনা বরং বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাকে ক্ষুণ্ন করবে।

ব্যাংকিং উৎস থেকে ১৩৭৫০০ কোটি, ব্যাংক বহির্ভূত ঋণ বাবদ ২৩৪০০ কোটি টাকা, বিদেশী ঋণ বাবদ ৯০৭০০ কোটি টাকা অর্থাৎ বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে অর্থমন্ত্রীকে ২৭,৪৪,০০ কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ করতে হবে এর উপর আছে ৪৪০০০ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বৈদেশিক অনুদান। আগে ঋণ বাবদ প্রস্তাবিত বছরে সরকারকে ১,১৩,৫০০ কোটি টাকা সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশ যেখানে সুদী লেনদেন হারাম হবার কথা সেখানে সরকার এই হারাম ঋণ ও সুদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছেন বলে মনে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতির হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। দ্রব্যমূল্য ধনী নির্ধন নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের নাগালের বাইরে। এতে তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। ইউনিসেফ সম্প্রতি তার একটি রিপোর্টে বলেছে যে, বাংলাদেশে এখন প্রতিটি শিশুর মধ্যে ৩ জন ভয়াবহ অপুষ্টিতে ভুগছে। এই অপুষ্টি তাদের বেড়ে উঠা মেধার বিকাশ, শিক্ষা দীক্ষার অগ্রগতি ও কর্মক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করবে। মূল্যস্ফীতি হ্রাস ও দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতি রোধ, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণের ক্ষেত্রে বাজেটের প্রতিশ্রুতি ও প্রস্তাবনা হতাশাব্যঞ্জক। যে দ্রব্যমূল্য আজকেই কমানোর ব্যবস্থা করা দরকার সেখানে অর্থমন্ত্রী যখন বলেন যে, ছয় মাস পর মূল্যস্ফীতি কমবে তখন তা পরিহাসের মতো শোনায়। সরকারের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা প্রাইস সিন্ডিকেটের সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্য নেয়া না হলে অবস্থার উন্নতি হতে পারেনা। একইভাবে পরিবহন খাতের নৈরাজ্যের অবসানের জন্য সরকারি কোনও উদ্যোগ বাজেটে পরিলক্ষিত হয়নি।

এক কথায় বলতে গেলে সদ্য ঘোষিত বাজেট মানুষের কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই ডেকে আনতে বাধ্য। বাজটের আকার বিশাল হলেই হয়না তা বাস্তবায়নের সাথে যারা জড়িত তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততাও অপরিহার্য। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের আমলাদের তার কোনটাই নেই। তাদের যারা চালান সেই মন্ত্রী-রাজনীতিবিদদের অবস্থা আরো খারাপ। শিক্ষা-প্রশিক্ষণ উভয় ক্ষেত্রে তারা দুর্বল।

লেখকঃ প্রাবন্ধিক এবং সহকারী সম্পাদক, দৈনিক সংগ্রাম

লেখাটি দৈনিক সংগ্রামে পূর্ব প্রকাশিত

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প  ও কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

ফেসবুকে লেখক ড. মোঃ নুরুল আমিন 

আরও পড়ুন