Ads

সাবেক পুলিশপ্রধানের অপকর্ম ও ব্যভিচারের নতুন সংজ্ঞা

।। ড. মো. নূরুল আমিন ।।

ষাটের দশকের প্রথমদিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের এক যুবক নিখিল পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং সিএসপি হন। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হবার পর পরই তিনি পিতার নির্দেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার গ্রামের বাড়িতে দাদীর সাথে দেখা করে তার দোয়া কামনা করেন। দাদী তার মাথায় হাত রেখে আল্লাহর দরবারে তার জন্য দোয়া করে বলেন যে, তিনি যেন তোমাকে দারোগা বানিয়ে দেন। তার দোয়া শুনে ভদ্রলোক সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তার প্রথম পোস্টিং হয়েছিল চাঁদপুরের মহকুমা প্রশাসক হিসেবে (SDO), যে পদটি ছিল দারোগা পদের অনেক উপরে। বলাবাহুল্য ঐ সময়ে থানার দারোগার পদটি সরকারি চাকরির তৃতীয় শ্রেণির একটি পদ ছিল। এসডিওর পদটি প্রথম শ্রেণির, তিনি মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের পদও ধারণ করতেন এবং নিয়মিত বিচারকের এজলাশে বসতেন। এত বড় পদের জন্য তাকে দোয়া না করে কেন দাদী তাকে দারোগা বানানোর জন্য দোয়া করলেন এটি একটি প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয় ছিল। কিছু কিছু দারোগা বা পুলিশ কর্মকর্তাদের দাপট, মানুষের ওপর জুলুম-অত্যাচার ও দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার সম্ভবত তাদেরকে মানুষের কাছে প্রভাবশালী ব্যক্তির আসনে আসীন করেছিল এবং সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের ওপর ছড়ি ঘুরানোর ক্ষমতা দিয়েছিল। সম্ভবত এ জন্যই তারা দাদীদের ন্যায় সহজ সরল মানুষের কাছে  কাঙ্ক্ষিত ও পূজনীয় ব্যক্তি ছিলেন।

বাংলাদেশ পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত আইজিপি বা মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, মানুষের ওপর অত্যাচার, ক্রসফায়ার ও গানফাইটের নামে মানুষ হত্যা, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অবজ্ঞা,  তার লংঘন, ভয়ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টি করে সম্পত্তি দখল ও নামমাত্র মূল্যে তা বিক্রিতে বাধ্য করা প্রভৃতির যে নৃশংস বিবরণী গত কয়েক মাস ধরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে তা রীতিমতো ভীতিকর, চমকপ্রদ ও লোমহর্ষক।

জনাব বেনজীর ১৯৮৮ সালে পুলিশ সার্ভিসে যোগ দেন। ২০১০ থেকে জানুয়ারি ২০১৫ সাল পর্যন্ত ডিএমপি কমিশনার হিসেবে, ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত র‌্যাবের মহাপরিচালক এবং ২০২০ সালের মে থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশের আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই দায়িত্ব পালনকালে ২০১১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সময়ে তিনি ৫ বার পুলিশ বিভাগের সর্বোচ্চ খেতাবে ভূষিত হন। ২০২০-২১ সালে পুলিশের ইন্টেগ্রিটি খেতাবও পান। দুর্নীতি দমন কমিশনের তথ্যানুযায়ী এই সময়ে তিনি ও তার পরিবার ৮৭.৯ একর জমিও ক্রয় করেন। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী জনাব বেনজীর, তার স্ত্রী ও মেয়েদের নামে ও হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে গোপালগঞ্জ সদর ও মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায় ৬০০ বিঘার (২০০ একর) বেশি ধানী জমি নামমাত্র মূল্যে ক্রয় করেন। অভিযোগ অনুযায়ী এ কাজে তিনি তৈমুর ইসলাম নামক আরেকজন পুলিশ অফিসারকে ব্যবহার করেন, যিনি নানা ভয়ভীতি প্রদর্শন ও প্রলোভন দেখিয়ে হিন্দুদের কাবু করতে সহায়তা করেন।

আরও পড়ুন-

নারীবাদ প্রাচ্যকেও যেভাবে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেবে

বেনজীর আহমদ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অবসর গ্রহণের পর তিনি স্বয়ং এবং সরকার তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং তাকে অবসর-উত্তর পুলিশ প্রটেকশান দেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করেন। এতে বলা হয় যে, তার নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিকভাবে ইউনিফরম ও অস্ত্রধারী দু’জন বডিগার্ড নিয়োজিত থাকবেন। এছাড়াও সাদা পোশাকে স্বতন্ত্র গাড়িতে জনাব বেনজীরকে পুলিশ সদস্যরা পাহারা দিয়ে নিয়ে যাবেন এবং বাসায় ২৪ ঘণ্টা তিনজন গার্ড নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবেন।

গত ২৩ মে আদালতের আদেশে জনাব বেনজীরের মোট ৬২৭ বিঘা জমি ক্রয়ের ৮৩টি দলিল ৩৩টি ব্যাংক হিসাব এবং ২৬ মে তিনি এবং তার পরিবারের ১১৯টি জমির দলিল, ২৩টি কোম্পানির শেয়ার এবং গুলশানের ৪টি ফ্ল্যাট জব্দ করা হয়। তার বিদেশ যাত্রার উপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু সরকার প্রদত্ত তার পুলিশি নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে সরকারি কোনো নির্দেশ জারির খবর পাওয়া যায়নি। অনেকে ধারণা করছেন যে  পুলিশি নিরাপত্তা নিয়েই তিনি দেশত্যাগ করেছেন। ঘটনাটি  অদ্ভূত নয় কি?

জনাব বেনজীরের ঘটনার অনুসরণে পুলিশের আরো কয়েকজন কর্মকর্তা বিশেষ করে সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মতিয়ুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে দুর্নীতির অর্থে-তার বাড়ি গাড়ির তুলনায় জমি ক্রয় ও রিসর্ট ব্যবসার প্রতি বেশি আগ্রহ ও পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছেন। বেনজিরের সাভানা ইকো রিসর্টটির তত্ত্বাবধান এখন সরকারি ব্যবস্থাপনার অধীনে চলছে। ১৪ জুন থেকে ১৯ জুন পযর্ন্ত ৬ দিনের এর আয় বাবত সরকারি কোষাগারে ৩,২৬,৪৬১ টাকা জমা হয়েছে এই সরকারের আমলে বাংলাদেশ কত হাজার বেনজীরের জন্ম হয়েছে তার হিসাব বের করা সহজ নয়, তবে অনেকে নিশ্চিত করে বলেন যে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া বা অবসরের পর এই সব রাজা মহারাজাদের এবং মহারানীদেরও অনেকে উলঙ্গ হয়ে যাবার সম্ভাবনা খুব বেশি। আমাদের সমাজ দেহে এত ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে যে ওষুধ দিয়েও কুলানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাদের এ অবস্থা দেখে প্রখ্যাত পণ্ডিত রুশ দার্শনিক লিউ টলষ্টয়ের একটি ছোট গল্পের কথা আমার মনে পড়ে।  Leo tolstoy এবং Kallie Wilbourne এর যৌথভাবে প্রণীত একটি পুস্তকেও এই গল্পটি ঠাঁই পেয়েছে। গল্পের শিরোনাম How much land does a man Need” একজন মানুষের কতটুকু জমি প্রয়োজন? গল্পের নায়কের নাম পাখম। তিনি গ্রামের মধ্যবিত্ত সুখী একটি পরিবারের প্রধান। লোভ লালসাবিহীন সুখী তার পরিবার। হঠাৎ জমি জমা বৃদ্ধির প্রতি তার আগ্রহের সৃষ্টি হলো। জমি বৃদ্ধির আকাঙ্খা তাকে পাগল করে তুললো। তিনি এতই লোভী হয়ে উঠেন যে শয়তান তাকে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। তাকে এমনভাবে প্ররোচিত করে যে জমি পাবার জন্য যে হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। শয়তান পাখমকে বিশাল মাঠের অসীম দিগন্ত দেখিয়ে দৌড় প্রতিযোগিতয় লাগিয়ে দিয়ে বাহবা দিতে থাকে এবং আশ্বাস দেয় যে তীব্র গতিতে তুমি যত দূর যেতে পারবে সবটাই তোমার হবে। পাখম দৌড়াতে দৌড়াতে শেষ পর্যন্ত এক যায়গায় গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে  যায় এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করে। মানুষজন এসে তাকে ঐ স্থানেই কবর দেয়। পরিমাপ করে দেখা যায় যে, যে যায়গাজুড়ে তার কবর তার আয়তন মাত্র ১৮ বর্গফুট, ৬ ফুট লম্বা, ৩ ফুট চওড়া। একজন মানুষের দাফনের জন্য এই ছয় ফুট লম্বা জমিই প্রয়োজন।

আরও পড়ুন-

ইতিহাসের অজ্ঞতা গোলামী ডেকে আনতে পারে ।। ২য় পর্ব

দুঃখের বিষয়, আমরা মৃত্যু ও পরকাল এবং হালাল হারাম এবং আল্লাহর প্রতি জবাবদিহিতার কথা ভুলে গেছি। মৃত্যুকে ভুলে যাওয়া সত্যিকার অর্থে অত্যন্ত অস্বাভাবিক, কারণ প্রতিনিয়ত আমরা মৃত্যুকে দেখছি, আমাদের পূর্ব পুরুষদের কেউই বেঁচে নেই। মানব জীবনের এই অমোঘ সত্যটি প্রত্যক্ষ করেও কি আমরা সংযত হতে পারিনা?  এখন অন্য প্রসঙ্গে আসি।

বন্ধুবর অধ্যাপক আবু ইউসুফ আমার হোয়াটস অ্যাপে জনৈকা লিমা আখতারের একটি লেখা পাঠিয়েছেন। লিমা আখতার যে বিষয়টির উপর লিখছেন সেই বিষয়টিকে আমরা সাধারণত নোংরা অপশব্দ হিসেবে দেখে থাকি এবং উচ্চারণ করতে লজ্জা বোধ করি। শব্দটিকে আমি ব্যভিচার বলবো। লিমা আখতারের লেখাটির শিরোনাম হচ্ছে “বেশ্যা একটি গালি: দেখেন মিলে কিনা!!” এর পর তিনি বেশ্যাদের শ্রেণীবিন্যাস করে প্রত্যেকের কাজের প্রকৃতি উল্লেখ করে একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন এবং প্রশ্ন করেছেন বেশ্যা চরিত্রটি কি খুব খারাপ? তার সংজ্ঞা ও বর্ণনানুযায়ী:

১। অবৈধভাবে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে যারা আজ সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এরাই হলো সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্ট বেশ্যা।

২। অর্থের বিনিময়ে যে নারী দেহ বিক্রি করে সে বেশ্যা।

৩। অর্থের বিনিময়ে যে নৈতিকতা বেচে সে বেশ্যা।

৪। অর্থের বিনিময়ে যে চাকরিতে নিয়োগ দেয় সে বেশ্যা।

৫। অর্থের বিনিময়ে যে ফাইলে সই করে সেও বেশ্যা।

৬। অর্থের বিনিময়ে যে আসামীকে জামিন দেয় সেও বেশ্যা।  আবার পদ পদোন্নতি ও বিত্ত বৈভবের বিনিময়ে অন্যায়ভাবে জেল জুলুম ও ফাঁসির আদেশ দেয় সেও বেশ্যাদের অন্তর্ভুক্ত।

৭। অর্থের বিনিময়ে যে দলের পদ দেয় সেও বেশ্যা।

৮। তবে যার বেঁচার মতো আরো কিছু থাকে না সেই নারী শুধু দেহ বেঁচে। যার কাছে বেঁচে তার নাম কী? লিমা আখতারের এই বর্ণনায় বেশ্যাবৃত্তির বাইরে আমাদের সমাজের কাউকে খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন।

লেখকঃ প্রাবন্ধিক এবং  সিনিয়র সহকারী সম্পাদক, দৈনিক সংগ্রাম

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প  ও কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

ফেসবুকে লেখক ড মোঃ নুরুল আমিন

আরও পড়ুন