Ads

জেনা-ব্যভিচার ও আমাদের সমাজ ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ

।। ড. মো. নূরুল আমিন ।।

সাম্প্রতিক বছরসমূহে একটি সংক্রামক ব্যধি বাংলাদেশে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে বলে মনে হয়। এই ব্যধিটি সর্বগ্রাসী, তার ব্যাপকতা ও প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এতে আমাদের মনুষ্যত্ব ও নৈতিক মূল্যবোধ ধ্বংস হবার উপক্রম হয়েছে। ব্যধিটির নাম ব্যভিচার, নৈতিকস্খলন তথা ধর্ষণ। এর সংক্রমণে গোটা বাংলাদেশ আজ বিধ্বস্ত। কথা আছে Money is lost nothing is lost, health is lost something is lost, Character is lost everything is lost বাংলাদেশের একশ্রেণীর মানুষ তাদের চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে, তাদের হারানোর মত আর কিছু নেই। এতে সভ্য দেশ হিসেবে আমাদের মাথা কাটা যাচ্ছে। ধর্ষণ-ব্যভিচার এত বেড়েছে যে, পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যদের সামনে মুখ দেখাতেও আমরা লজ্জা পাই। এই অবস্থায় গণদাবির প্রেক্ষাপটে সরকার ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করে একটি অধ্যাদেশ জারী করেছেন। গত শুক্রবার বাদ জুমা ইসলামী দলসমূহ ধর্ষণ-ব্যভিচার প্রতিরোধে ৬ দফা দাবি পেশ করে বলেছেন যে, শুধু আইন করলেই হবে না তা যথাযথভাবে প্রয়োগও করতে হবে। তাদের ৬ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে : (১) জি¦না-ব্যভিচারের সর্বোচ্চ শাস্তি জনসমক্ষে নিশ্চিত করা, (২) পর্ণোগ্রাফির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, (৩) মাদকদ্রব্যের অবাধ প্রাপ্তি ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা, (৪) নারীর অশ্লীল উপস্থাপনা ও তাদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার রোধ করা, (৫) আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ ও হস্তক্ষেপমুক্ত বিচার নিশ্চিতকরণ, (৬) নারীর মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণে কুরআন-হাদীসের শিক্ষাসমূহ পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্তকরণ। এখন মূল প্রসঙ্গে আসি। যৌনতা ও জ্বিনা ব্যভিচার প্রসঙ্গ : স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, যে বিষয়টি নিয়ে আমি এখন লিখছি সে বিষয়টি শুধু যে স্পর্শকাতর তা নয়; অনেকের কাছে তা একটি নিষিদ্ধ বিষয়ও। যৌনতা সম্পর্কিত বিষয়টির একটি ঐন্দ্রজালিক প্রভাব আছে, এর একটি সার্বজনীন আবেদনও আছে। এর সাথে বাছবিচারহীন যৌন সম্ভোগ, ইতরামি, অসচ্চরিত্রতা, জ্বিনা, ব্যভিচার ধর্ষণ, পরকীয়া, অবৈধ গর্ভ ও গর্ভপাত, মাদক ব্যবসা ও মাদকাসক্তি, গর্ভ নিরোধ, এইডস, যৌন রোগ, পারিবারিক বিপর্যয় প্রভৃতির সম্পর্কও রয়েছে।

আমি অবজার্ভার গ্রুপের মালিক মরহুম হামিদুল হক চৌধুরীর একটা উক্তিকে এখানে স্মরণ করছি। পাকিস্তান আমলে প্রায়ই রাজধানীর হোটেলগুলোতে পুলিশ রেইড করতো। খদ্দেরসহ দেহপশারিনীরা গ্রেফতার হতো। অবজার্ভার পূর্বদেশসহ পত্রিকাগুলোতে ছবিসহ খবর ছাপা হতো। তিনি এটা পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন যে, এগুলো পুলিশের কারসাজি। তারা পয়সা খেয়ে আসামী ছেড়ে দিত অথবা এমনভাবে মামলা দিত যাতে তারা ছাড়া পেয়ে পূর্বতন পেশা ও পূর্বতন স্থানে ফিরে যেতে পারে। মাঝখানে সমাজবিরোধী বদমাশরা তাদের যাবার ঠিকানা পেয়ে যেতো। তার কথায় যুক্তি ছিল। এ ব্যবসা এখনো চলছে। গ্রেফতার জামিনের ঘটনারও পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এতে সমস্যা কমেনি বেড়েছে। সেক্স এখন কোথায় নেই? টেলিভিশন, সিনেমা, নাটক, পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন, বিজ্ঞাপন সর্বত্র সেক্স-এর ছড়াছড়ি। ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রতিটি বাড়িতে ব্লু ফিল্ম ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ডিস চ্যানেলের নারী-পুরুষের মিলন দৃশ্য স্বাভাবিক ব্যাপার, আলিঙ্গন, চুম্বন, নারী দেহের নগ্ন প্রদর্শনী ছাড়া নাটক নেই, সিনেমা তো কল্পনাই করা যায় না। জিমন্যাস্টিকস এক্রোবেটিকস এর নামে উলঙ্গ নারীর খোলামেলা প্রদর্শনী অহরহ দেখা যাচ্ছে। শহর নগরের প্রতিটি অলি-গলিতে ভিডিও’র দোকানে শুধু পর্নো ছবি নয়; তার সাথে নারীও পাওয়া যাচ্ছে। আবাসিক হোটেলগুলোতে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত ঘরের স্ত্রী-কন্যারা পার্টটাইম যৌন সঙ্গী হয়ে টু পাইস কামাই করছে। বস্তিগুলোতে বিফ ফ্যাটেনিংএর ন্যায় ব্লু ফ্লিম এর নায়িকা তৈরির জন্য মোটাতাজাকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। দশকের পর দশক ধরে নির্বাচিত কিছু সিনেমা হল এবং এমনকি বিজিবি ও সেনাবাহিনীর পরিচালিত সিনেমা হলগুলোতে তিন শিফট-এ উলঙ্গ ছবির প্রদর্শনী চলে এসেছে। কিশোর যুবক প্রৌঢ় বৃদ্ধরাও লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে এগুলো উপভোগ করে এসেছে। পত্রপত্রিকায় সচিত্র খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা কখনো পর্যাপ্ত ছিল না। এ অবস্থায় মাঝে মধ্যে কয়েকজন পথভ্রষ্ট তরুণ তরুণীর গ্রেফতার যে সমস্যার সমাধান করবে তা বিশ্বাস করার মতো যুক্তি আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তবে সময়ে সময়ে অশ্লীলতা নির্মূলের জন্য যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় তাকে আমি অভিনন্দন জানাই এবং এর সাফল্য কামনা করি। এজন্য এ অভিযানকে সামগ্রিক রূপ দেয়া বাঞ্ছনীয়। প্রচার মাধ্যমের অশ্লীলতা রোধ করতে না পারলে এ উদ্যোগ সফল হতে পারে না। তেমনি গার্মেন্টস কিংবা বস্তির সুন্দরী মেয়েটির পেছনে পুলিশের যে লম্পট সদস্যটিকে নেংটি কুকুরের মতো ঘুরঘুর করতে দেখা যায় তাকে নিয়ন্ত্রণ করাও জরুরি।

এর পাশাপাশি জ্বিনা ব্যভিচার রোধকল্পে আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধগুলোকে উজ্জীবিত করাও অপরিহার্য বলে আমি মনে করি। জ্বিনা ব্যভিচারের বিষয়টি অনেকের কাছেই স্বচ্ছ নয়, বিশেষ করে যুব-সমাজকে এ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দেয়া জরুরি বলে মনে হয়। তাদের বুঝতে হবে যে, বৈধভাবে বিবাহিত দম্পতি নয় এমন ব্যক্তিদের মধ্যে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের নাম হচ্ছে ব্যভিচার এবং এর ধরন দু’রকম। বিবাহিত ও অবিবাহিত ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক। বিবাহিত পুরুষ ও বিবাহিতা পরনারীর মধ্যে সম্পর্ক। ইসলামের দৃষ্টিতে এই উভয় প্রকারের সম্পর্কই হারাম। এটা মানুষের রুচি ও মূল্যবোধ পরিপন্থী। কেননা, কোনও মানুষ তার মা, স্ত্রী, কন্যা অথবা বোনকে ব্যভিচারী হিসেবে সহ্য করতে পারে না। পারিবারিক শৃঙ্খলা ও সংহতির জন্যও ব্যভিচার মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে। স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক একটি পবিত্রতম সম্পর্ক। যদি কোনও স্বামী বা স্ত্রী এই সম্পর্কের বাইরে গিয়ে অন্য কারোর সাথে গোপন অভিসারে লিপ্ত হয় এবং যৌনাচারে জড়িয়ে পড়ে তাহলে যে আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর তাদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা ভেঙে পড়ে। অপরাধী ব্যক্তি যৌন রোগে আক্রান্ত হয়ে নিরপরাধ ব্যক্তির মধ্যে তা ছড়িয়ে দিতে পারে। এতে মেয়েরাই সাধারণত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনাচার ও বিশ্বাস ভঙ্গের কারণে পরিবারে যখন কলহবিবাদ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে পড়ে তখন স্বামী-স্ত্রীর পক্ষে এক ছাদের নিচে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ে। ছেলেমেয়ে থাকলে তারা উচ্ছন্নে যেতে থাকে। স্ত্রীর পক্ষে তখন দুটি পথ খোলা থাকে। এক তার সন্তানের পিতা কী করছে তা উপেক্ষা করা এবং ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসারে কোনো রকমে টিকে থাকা অথবা তালাক নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরে যাওয়া এবং প্রতিবেশী ও ভাবীদের গঞ্জনার মধ্যে মৃত্যুর অপেক্ষা করা। যাদের নিজস্ব কোনও আয় উপার্জন নেই, সন্তান নিয়ে দারিদ্র্যের মধ্যে বেঁচে থাকা তাদের জন্য দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে তাদের দুর্দশা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। আধুনিক শিক্ষিত পরিবারসমূহে যে ভাঙন পরিলক্ষিত হয় তার বেশিরভাগই বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কারণে হচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার বলি হচ্ছে সংসার, সন্তানদের ভাবাবেগ ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতচিহ্ন নিয়েই তাদের বড় হতে হচ্ছে। সমাজ সভ্যতার সুতিকাগার পরিবারকে এ অবস্থা থেকে রক্ষা করার জন্য মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে মানুষের পছন্দ অপছন্দের ওপর দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

সূরা আল আরাফ এর ৩৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “বলুন আমার পালনকর্তা নিশ্চিতভাবে ঐ সমস্ত কাজকে হারাম বা নিষিদ্ধ করেছেন যেগুলো অশ্লীল ও লজ্জাকর তা প্রকাশ্য হোক কিংবা গোপন।”  একইভাবে সূরা বনি ইসরাইলের ৩২ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “আর ব্যভিচারের কাছেও যেও না, নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল ও মন্দ কাজ যা আরো অন্যায় কাজের পথ প্রদর্শক।”

জ্বিনা : যদি কোনও ব্যক্তি বিয়ের পূর্বে অন্য কোনও ব্যক্তির সাথে সংসর্গ স্থাপন করে তাহলে তাকে জ্বিনা বলা হয়, ব্যভিচারের ন্যায় জ্বিনাও দু’প্রকার : ১. অবিবাহিত কোনও ব্যক্তি যদি অবিবাহিত অন্য কোনও ব্যক্তির সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে তাহলে জ্বিনা হয়।

জেনা-ব্যভিচার যেন সবচেয়ে সহজলভ্য !

২. যদি কোনও অবিবাহিত ব্যক্তি কোনও বিবাহিত ব্যক্তির সাথে মিলিত হয় তাহলেও জ্বিনা হয়। এক্ষেত্রে অবিবাহিত ব্যক্তির জন্য হয় জ্বিনা এবং বিবাহিত ব্যক্তির জন্য ব্যভিচার। সূরা ফুরকানের ৬৮ এবং ৬৯ নং আয়াতে আল্লাহ জ্বিনা ব্যভিচারের ভয়াবহ শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন। এতে বলা হয়েছে, “যারা আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যের এবাদত করে না, আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সঙ্গত কারণ ব্যতীত তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না তারা ছাড়া যারা এ কাজ করে তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে। কেয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দ্বিগুণ হবে এবং তথায় লাঞ্ছিত অবস্থায় চিরকাল বসবাস করবে।” এই আয়াতে আল্লাহ তিনটি ভয়াবহ পাপ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে : এক. আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা। দুই. হত্যা এবং তিন. জ্বিনা-ব্যভিচার।

রাসূল (সা.) বলেছেন, যখন কোনও ব্যক্তি জ্বিনা করে তখন ঈমান তাকে পরিত্যাগ করে, তার মাথার উপর ক্যানভাসের ছাদের ন্যায় একটি বস্তু অবস্থান নেয়। যখন সে জ্বিনার কাজ পরিত্যাগ করে তখন ঈমান তার কাছে ফিরে আসে (আবু দাউদ-৪৬৭৩)। তিনি আরো বলেছেন, যে অবৈধ যৌন সংসর্গে লিপ্ত হয় সে ঐ সংসর্গকালে ঈমানদার থাকে না, একজন চোর চুরি করার সময় মুমিন নয়, একজন মদ্যপ ব্যক্তি মদপান করার সময়ও ঈমানদার নয়, তথাপিও তার পর তার জন্য অনুশোচনার দরজা খোলা (আল-বোখারী-৮,৮০১)

সূরা নূর এর ২নং আয়াতে জ্বিনা-ব্যভিচারের শাস্তি বর্ণনা করা হয়েছে। এতে আল্লাহ এরশাদ করেছেন, ব্যভিচারিনী নারী, ব্যভিচারী পুরুষ তাদের প্রত্যেককে ১০০ করে বেত্রাঘাত করো। আল্লাহর বিধান কার্যকরকরণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়। যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো। আবার এই অবৈধ সম্পর্কের কারণে যদি ব্যভিচারিনী নারী গর্ভধারণ করে তাহলে তিরমিযি শরীফের হাদীস অনুযায়ী ভূমিষ্ঠ সন্তান কোনও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে না। এই হাদীসে বলা হয়েছে, যদি কোনও লোক কোন স্বাধীন অথবা গোলাম মহিলার সাথে জ্বিনা করে এবং এই জ্বিনার ফলে সন্তানের জন্ম হয় তাহলে সেই সন্তান যেমন কারুর উত্তরাধিকারী হতে পারে না তেমনি অন্য কেউও তার উত্তরাধিকারী হতে পারে না (তিরমিযি-৩০৫৪)

মুসলিম সমাজে বিয়েই হচ্ছে একমাত্র আইনসঙ্গত শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক অনুমোদন যা স্বামী-স্ত্রীকে একত্র বাস এবং মেলামেশার অধিকার দেয়। যাদের বিয়ে করার সামর্থ নেই সূরা নূর এর ৩৩ নং আয়াতে তাদের সংযমী হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, যারা বিবাহে সমর্থ নয় তারা যেন সংযম অবলম্বন করে, যে পর্যন্ত না আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা আল আহযাব এর ৩৫ নং আয়াতে এদের জন্য ক্ষমা ও মহাপুরস্কারও ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, নিশ্চয়ই মুসলমান পুরুষ মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ দানশীল নারী, রোযা পালনকারী পুরুষ রোযা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হেফাজতকারী পুরুষ যৌনাঙ্গ হেফাজতকারী নারী, আল্লাহর অধিক যেকেরকারী পুরুষ ও যেকেরকারী নারী তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কার। মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম মহিলাদের বিয়ে করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন, বিয়ে আমার সুন্নাত। যে এই সুন্নাতকে উপেক্ষা করবে সে আমার দলভুক্ত নয়। ইসলামে বিয়েকে সহজ এবং জ্বিনা-ব্যভিচারকে কঠিন করা হয়েছে। জীবনসঙ্গী নির্বাচনের জন্য এখানে অনেক দিকনির্দেশনাও রয়েছে। এই পছন্দকে আকস্মিকতা বা হঠাৎ ভালো লাগা কিংবা ভাবাবেগ ও যৌনতা তাড়িত প্রেম ভালোবাসার উপর ছেড়ে দেয়া যায় না। অর্থাভাবে যারা বিয়েশাদী করতে পারে না তাদের সাময়িক মজবুরি জ্বিনা ব্যভিচারের অধিকারও দেয় না বরং চরিত্র ও সতিত্ব রক্ষা এবং ধৈর্যসহকারে আল্লাহর সাহায্য চাওয়ার জন্য তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। চারিত্রিক সততার পাহারা আল্লাহর তরফ থেকে নিঃসন্দেহে একটা পরীক্ষা এবং এ পরীক্ষায় পাস করার জন্য দৃঢ় মনোবল এবং কঠোর শৃঙ্খলার অনুশীলন প্রয়োজন। যারা হাজারো প্ররোচনা, লোভ-লালসা এবং ভয়ভীতির মধ্যেও জ্বিনা-ব্যভিচার ও অশ্লীল কাজকর্ম থেকে বেঁচে থাকতে পারে তাদের জন্য আল্লাহ ক্ষমা এবং মহাপুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। যারা জ্বিনা-ব্যভিচারের স্বাদ নিয়ে পরে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় সূরা নূর এর ৩ নং আয়াতে আল্লাহ তাদের জন্য পরিষ্কার দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ব্যভিচারী পুরুষ, ব্যভিচারী নারী অথবা মুশরিক নারীকে ছাড়া অন্য কাউকে বিবাহ করবে না এবং ব্যভিচারিণীকে কেবল ব্যভিচারী অথবা মুশরিক পুরুষই বিবাহ করবে এবং এদের মুমিনদের হারাম করা হয়েছে। সূরা আল মায়েদার ৫ নং আয়াতে ঈমানদারদের জন্যও দিকনির্দেশনা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, তোমাদের জন্য হালাল সতি-সাধ্বী নারী যাদের তোমাদের পূর্বে কেতাব দেয়া হয়েছে। যখন তোমরা তাদেরকে মোহরানা প্রদান কর তোমাদের স্ত্রী করার জন্য, কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য কিংবা গুপ্ত প্রেমের জন্য নয়।

ব্যভিচারের বিস্তৃতি বিয়ের প্রয়োজন বিলোপ করছে কি?

উপরোক্ত আয়াতগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, বিবাহের পূর্বে এবং পরে তথা বিবাহকালীন যৌন পবিত্রতা রক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করা এবং জীবনসঙ্গী নির্বাচনে দিকনির্দেশনা প্রদান করাই হচ্ছে এগুলো নাযিলের প্রধান উদ্দেশ্য। আধুনিক শিক্ষিতদের মধ্যে এমনকি মুসলিম সমাজে এখন এমন অসংখ্য লোক আছেন যারা মনে করেন যে বিয়ের পূর্বে কিংবা বিবাহিত জীবনে বহুগামিতা কোন অপরাধই নয়। তারা জ্বিনা-ব্যভিচার করাকে নতুন নতুন স্বাদ আস্বাদনের অধিকার বলে মনে করেন। এরাই আবার নিজের স্ত্রী, পুত্র কন্যার জন্য চারিত্রিক সততাকে অপরিহার্য বলে ধরে নেন। আমাদের আলেম সমাজ, ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মী এবং ঈমানদার সাধারণ মুসলমানদের এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে এবং আইন ও সামাজিক অনুশাসনের মাধ্যমে এই অনাচারগুলো সমাজ থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টায় ব্রতি হওয়া অপরিহার্য বলে আমি মনে করি।

এখানে কয়েকটি বিষয় জড়িত। একটি হচ্ছে চলমান সেন্টিমেন্ট অনুযায়ী অধ্যক্ষ সিরাজুদ্দৌলা কর্তৃক নুসরাত রাফির শ্লীলতাহানী ও পরবর্তীকালে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে তাকে হত্যার বিচার। এই বিচারের জন্য সারা দুনিয়া অপেক্ষা করছে। প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছেন। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে আদালত প্রচলিত আইনে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করবে। আমি এই আস্থা পোষণ করি। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে দেশব্যাপী ধর্ষণ গণধর্ষণ ও ধর্ষণোত্তর হত্যার যে নারকীয় ঘটনাগুলো ঘটেছে তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তি। এই বিচারের অনেকগুলো বাধা আছে, এর মধ্যে পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য, সমাজের প্রভাবশালী নেতা ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এই বাধার সাথে জড়িত। তাদের বলয় থেকে বেরিয়ে এসে সরকারকেই এই শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আইন ও প্রশাসনের দুর্বলতায় ধর্ষকশ্রেণি এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এরা শাস্তি পাচ্ছে না। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের গণধর্ষণের সাথে যারা জড়িত ছিল তাদের যদি কঠোর শাস্তি দেয়া হতো তাহলে পরবর্তী ঘটনাগুলো ঘটতো না, মামলা মোকদ্দমা এখন পুলিশ বাহিনী, প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দলের কিছু লোকের আয় উপার্জনের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য আমরা বিপুল অর্থ ব্যয় করি। এই প্রশিক্ষণে নৈতিকতার কোন মডিউল নেই। এটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা কি আমরা ভুলে গেছি? পুত্র ধর্ষণের আসামী, পিতার লজ্জায় মাথানত হবার কথা। কিন্তু তিনি পুত্রের পক্ষে সাফাই গেয়ে কি বললেন? উঠতি বয়সে ছেলেরা তো কিছু স্ফূর্তি করবেই। আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে এ থেকেই বোঝা যায়। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার এবং সরকারি দলের ভূমিকা অপরিসীম। আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক ছাত্রলীগ নেতা কর্তৃক ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপন কিংবা ইডেন ও আনন্দ মোহনের ছাত্রীদের প্রেস কনফারেন্সে রাজনৈতিক নেতা ব্যবসায়ী ও বিদেশীদের মনোরঞ্জনে অনৈতিক কাজে তাদের বাধ্য করার অভিযোগের বিষয়টিও এখানে স্মরণ করিয়ে দেব না। আজ রাস্তা ঘাট, শহর গ্রাম, গাড়ি ঘোড়া, স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসা মক্তব কোথাও মেয়েদের নিরাপত্তা নেই। তারা যদি নিরাপদ না হয় তাহলে আমরা মা পাবো কোথায়? মা’ই যদি না থাকে দুনিয়াতে, এই দেশকে ধারণ করবে কে?

আলোচনার শুরুতে আমি সংক্রামক ব্যধির কথা বলেছিলাম। ওলাওঠা নির্মূলের জন্য এই দেশকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয়েছে। রাস্তা ঘাটে, ঝোপ জঙ্গলের আড়ালে পায়খানা করার পরিবর্তে নির্দিষ্ট জায়গায় ওয়াটার সীলড ল্যাট্রিন ব্যবহার এবং সাবান দিয়ে হাত ধোয়া শেখাতে হয়েছে। বিনা পয়সায় ও পরে কম পয়সায় পায়খানার রিং ও স্ল্যাব সরবরাহ করতে হয়েছে। সামাজিক ব্যধি ধর্ষণ-শ্লীলতাহানি রোধের জন্যও এই ধরনের নৈতিক শিক্ষা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রয়োজন। ইন্টারনেট ও প্রচার মাধ্যমে অশ্লীল ছবি ও ব্লু ফ্লিম, যৌনতা এবং পার্ক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ক্লাবে অশ্লীল আচার অনুষ্ঠান বন্ধ করতে হবে। উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের শ্রেণিকক্ষে যৌন শিক্ষা প্রদান ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সামনে উলঙ্গ নারীর প্রদর্শনী করে তা হতে পারে না। এটা নারীর প্রতি আমাদের মা’দের প্রতি অমর্যাদা। সহশিক্ষা ও মেয়েদের শ্রেণিকক্ষে পুরুষ শিক্ষকদের শিক্ষাদান কার্যক্রম কমিয়ে এ কাজে যথাসম্ভব মেয়েদের ব্যবহার করা হলে পরিবেশ আরো ভাল হতে পারে। এর সাথে যদি ইসলামী দলগুলোর ৬ দফা দাবি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তাহলে আশা করা যায় যে, আমাদের সমাজ কলুষমুক্ত হতে পারবে।

লেখকঃ প্রাবন্ধিক এবং সিনিয়র সহকারী সম্পাদক, দৈনিক সংগ্রাম

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প  ও কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

ফেসবুকে লেখক ড. মোঃ নুরুল আমিন 

আরও পড়ুন